1. ভূমিকা: মনুষ্য জগৎ, ঘরবাড়ি, কলকারখানা, গাছপালা জীবাণু সব কিছুর মিশ্রনকেই পরিবেশ বলো পরিবেশ দুই প্রকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সামাজিক পরিবেশ। যে পরিবেশ আপনা থেকেই গড়ে ওঠে তাকে প্রাকৃতিক পরিবেশ বলে। মানুষ নিজে যে পরিবেশ গড়ে তোলে তাকে সামাজিক পরিবেশ বা কৃত্রিম পরিবেশ বলে।
2. মানব জীবনে প্রকৃতি পরিবেশের প্রভাব: প্রাকৃতিক পরিবেশ হল, নদীনালা, গাছপালা, মাঠঘাট, পাহাড়-পর্বত, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র ইত্যাদি। প্রাণী জগৎ উদ্ভিদ জগতের উপর নির্ভরশীল। প্রাণী জগতের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন একমাত্র উদ্ভিদ জগৎ থেকেই পাই। নদীনালা থেকে আমরা পানীয় জল ও সেচের জল পাই। পাহাড় পর্বত ঋতু ত্বরান্তিত ও বিলম্বিত করে মানব জগতের উপকার করে। চন্দ্র, সূর্য জোয়ার ভাটা ও তাপমাত্রার হেরফের ঘটায়। এইভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রতিনিয়ত মানব জাতির উন্নতি করে চলেছে।
3. মানব জীবন ও সামাজিক পরিবেশ: প্রাণী জগৎ যেমন উদ্ভিদ জগতের উপর নির্ভরশীল ঠিক তেমনি উদ্ভিদ জগতও প্রাণীজগতের উপর নির্ভরশীল। উদ্ভিদের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড পায় প্রাণী জগৎ থেকে। সামাজিক পরিবেশ হল মনুষ্য নির্মিত ঘর, বাড়ি, রাস্তাঘাট, কলকারখানা যানবাহন প্রভৃতি। সামাজিক পরিবেশ দ্বারা মানুষের জীবন যাত্রা আগের থেকে অনেক গতিশীল এবং উন্নতশীল হয়েছে। কলকারখানা কর্মসংস্থান হয়েছে বেশি। যাতায়াতের সময় আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। আকাশ চুম্বী ঘরবাড়িতে কম জায়গায় অনেক বেশি বাসস্থান সম্ভব হয়েছে।
4. পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার গুরুত্বঃ প্রাণীজগৎ যেমন অক্সিজেনের জন্য উদ্ভিদ জগতের উপর নির্ভরশীল, উদ্ভিদ জগতও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের জন্য প্রাণী জগতের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু বর্তমানে পরিবেশ দূষণ যে পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে সেই পরিমানে গাছপালা সংরক্ষণ করা হচ্ছে না।
শহরে এই দুষন মাত্রার পরিমান অনেক বেশি, কারণ শহরে গাছপালার পরিমান অনেক কম। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে গেলে বৃক্ষ এবং বৃক্ষরোপনের ব্যবস্থার মাধ্যমেই তা সম্ভব। জীবজগত সুস্থ সবল থাকার জন্য প্রয়োজন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা। এই ভারসাম্য রক্ষার জন্য আমাদেরই সবার আগে উদ্যোগী হতে হবে।
5. উপসংহার: আমাদের এই পৃথিবী একটি অপর্প গ্রহ। একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ গ্রহ। বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী আছে এই গ্রহে। তাদের বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত উপকরণ পর্যাপ্ত পরিমানে মজুত আছে এই প্রাকৃতিক ভান্ডারে। দরকার তার সঠিক ব্যবহার।
6. শব্দদূষণ ও প্রতিকার ভূমিকা: আমাদের জীবনে দূষণ বড় ভীষণ আকার ধারন করেছে। শব্দ দূষণ, জলদূষণ, ও পরিবেশ দূষণ মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব ফেলছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। তার মধ্যে শব্দ দূষণ অন্যতম। মনুষ্য নির্মিত কলকারখানা, যানবাহন ও সামাজিক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, আতস বাজি নির্গত শব্দ আমাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে।
7. শব্দ দূষণ কী: বিভক্তি যানবাহনের হর্ণ, কলকারখানার বিকট আওয়াজ, বিভক্তি অনুষ্ঠান ও রাজনৈতিক সভায় ব্যবহৃত মাইকের নির্গত আওয়াজ, যা আমাদের শ্রবণেন্দ্রীয়ের সহ্য ক্ষমতার মাত্রা অতিক্রম করে তাকেই শব্দ দূষণ বলে। বিভক্তি আতসবাজির বিকট শব্দ বর্তমানে সমাজের সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ।
8. শব্দ দূষণ ও মানব জীবনঃ শব্দ দূষণ যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে মানব জীবনে চরম দূরবস্তা দেখা দেবে। অতিরিক্ত শব্দের ফলে মানুষ কালা, রক্ত চাপ বৃদ্ধি ও মানষিক বিকারের বশীভূত হতে পারে। অতিরিক্ত শব্দে মানুষের স্মৃতিশক্তি লোপ পায়, মানুষের হিংস্রতা বৃদ্ধি পায়। শব্দ দূষণের প্রতিকার ও নিয়ন্ত্রণ আমাদেরই করতে হবে। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব তাই সামাজিক, নৈতিক ও মানবিকতার খাতিরে এই দুষণের প্রভাব নিয়ে আমাদের সবাইকে চিন্তা করতে হবে।
9. আদালতের সাম্প্রতিক নির্দেশ: শব্দ দূষণের নিয়ন্ত্রণে আদালত সাম্প্রতিক কিছু নির্দেশজারী করেছে। নির্দেশগুলির মধ্যে কয়েকটি হল, স্কুল কলেজের কাছে হর্ণ বাজানো যাবে না, স্কুল, কলেজের ২০০-২৫০ গজের মধ্যে সভা করা যাবে না। হাসপাতাল, নার্সিংহোমের সামনে মাইক হর্ণ বাজানো যাবে না। কলকারখানার বিকট আওয়াজ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শব্দবাজি যেন কোন মতেই ৬৫ ডেসিবেলের বেশি না হয়। বিভক্তি সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত গান বাজনা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান রাত ১১টার পর নিষিদ্ধ করা।
10.শব্দ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা সমূহ: বিভিন্ন ব্যবস্থার মাধ্যমে শব্দ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। যেমন পথ সভা বা সভায়, গাড়ির হর্ণ বাজানো, কলকারখানার বিকট শব্দ আয়ত্বে আনতে হবে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা সামাজিক অনুষ্ঠান যথা সম্ভব সংক্ষেপে সারতে হবে। শব্দ দূষণের কু-প্রভাব সমন্ধে সবাইকে সচেতন করতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক ও মানবিক প্রয়োজনে শব্দ দুষণের প্রতিরোধ করতে হবে।
11. উপসংহার: পরিবেশকে শব্দ দূষণ মুক্ত করার জন্য আমাদের সকলকে যথেচ্ছ শব্দের ব্যবহার সীমিত রাখতে হবে। সকলের সম্মিলিত চেষ্টার ফলে শব্দ দূষণ মুক্ত হতে পারে আমাদের এই পরিবেশ। একটি সুস্থ পরিবেশের জন্য শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা অবশ্য কর্তব্য।
12. বেগম রোকেয়া ভূমিকা: বিদ্যার্জন করা প্রত্যেক মানুষের অবশ্য কর্তব্য। সে ছেলেই হোক বা মেয়ে, প্রত্যেকেরই শিক্ষিতমানুষ হওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু মুসলিম সমাজে একসময় মেয়েদের লেখা-পড়ার অধিকার ছিল না। সংরক্ষনশীল মুসলিম সমাজের এই ভুল নিয়মের বিরুদ্ধে যিনি শৈবব থেকেই সংগ্রাম ঘোষণা করেছিলেন এবং নিজে ঝুঁকি নিয়ে পড়াশোনা করে নিজেকে শিক্ষিত করেছিলেন এবং সমাজকে পরিবর্তন করার এক নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন, তিনিই হলেন বেগম রোকেয়া।
13. সংক্ষিপ্ত জীবন কথা: বাংলাদেশের রংপুর জেলার পায়-রাবন্দ গ্রামে ১৮৯০ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবার নাম আবু আলি সাহেব। মায়ের নাম রাহাতুন্নেসা। ১৮৯৬ সালে যোল বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হয়। স্বামীর নাম সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন। রোকেয়া স্বামীর সঙ্গে বিহারের ভাগলপুরে একসময় থাকতেন। তখনও তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যেতেন।
13. কর্মজীবন: স্বামী সাখাওয়াত হোসেন তার স্ত্রী লেখাপড়ার উৎসাহ দিতেন। ফলস্বরূপ রোকেয়া অনেক কিছু শিখে ফেললেন। গল্প, কবিতা লিখে ফেললেন। মুসলিম মেয়েদের লেখাপড়ার প্রয়োজনের কথা তিনি বারে বারে বলেছেন। পত্রিকায় ছাপা হতে লাগল তাঁর সব লেখা। সমাজের প্রত্যেক মানুষের মনে হতে লাগল যে সমাজে মেয়েদেরও লেখা-পড়া শেখার দরকার। সমাজে মেয়েরা যাতে করে লেখা-পড়া শিখতে পারে তারজন্য তিনি স্বামীর সহযোগিতায় ভাগলপুরে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করলেন।
14. উল্লেখযোগ্য কীর্তি: স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি ভাগলপুর ছেড়ে কলকাতায় চলে এলেন। এখানে স্বামীর নামে প্রতিষ্ঠা করলেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল। যে স্কুলটি বর্তমানে কলকাতার একটি স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই স্কুল করতে গিয়ে তিনি অনেক বাধা পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি পিছপা না হয়ে মাত্র ৮ জন ছাত্রী নিয়ে স্কুল শুরু করেছিলেন।
15. উপসংহার: ১৯৩২ সালের ৯ই ডিসেম্বর এই মহীয়সী নারীর জীবনাবসান হয়। কিন্তু আজও আমরা তাঁকে স্মরণ করি। মানুষ মারা যায় কিন্তু তার স্মরণীয় কীর্তি আজও আমাদের বাঙালীর হৃদয়ে জ্বলজ্বল করছে। মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার প্রসারের জন্য বেগম রোকেয়া আজও স্মরণীয়।
16. দেশভ্রমণ: শিক্ষা ও আনন্দ ভূমিকা: "বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি দেশে দেশে কত না নগরে রাজধানী মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মবু কত না অজনা জীব, কত না অপরিচিত তবু রয়ে গেল অগোচরে।" রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশভ্রমণ মানুষের জীবনে আনে বৃহত্তর আহ্বান। আনে অজানা সৌন্দর্যের সংবাদ। অচেনার সান্নিধ্যে তার মনে লাগে বিস্ময়ের শিহরণ। ভুলে যায় প্রতিদিনের তুচ্ছতা। প্রয়োজনের পৃথিবী তাকে ধরে রাখতে পারে না। দেশভ্রমণের নেশা তাকে টেনে নিয়ে যায় প্রকৃতির অবারিত মুক্তাঙ্গনে। অজানাকে জানার জন্যে, অদেখাকে দেখার জন্যে, আমাদের পরিচিত গন্ডির বাইরে অপরিচিত জগৎকে দেখার জন্যে অন্তরের আকুল আগ্রহে আনন্দ অনুভব করি। ইবনে বতুতা তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে লিখেছেন ভ্রমণ একজনকে প্রভুর সৃষ্টির রহস্য জানায় ভ্রমণ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে।
17. ভ্রমণের আনন্দ: ভ্রমণের আনন্দের আকর্ষণই ভাইকিংদের ভেলায় ভাসিয়ে শ্বেত ভালুকের দেশ নোভাস্কাশিয়ার নিয়ে গেছে মার্কো-পোলো ভাসতে ভাসতে এশিয়ার বিস্তীর্ণ স্তূপ পেরিয়ে চীনে, ইবনে বতুতাকে ঘরছাড়া করেছে এশিয়া আফ্রিকার দেশ থেকে দেশান্তরে। তাঁদের মনের গতির নেশায় বেজে উঠেছিল বিপুল সুদূরের ব্যাকুল বাঁশরীর মধুর ধ্বনি এবং সেই ধ্বনির কুহক হাতছানিতে দিগ-বিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে মায়াময় গৃহকোণ ত্যাগ করে অজানা পথে যাত্রা করেছিলেন। তাঁদের এই দুঃসাহসিক অভিযান মানবকুলক ভ্রমণের নেশায় অনাদিকাল ধরে উদ্দীপ্ত করে যাবে।
18. শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে দেশভ্রমণ বা দেশভ্রমণের উপকারিতা: দেশভ্রমণ শিক্ষার একটি প্রধান অঙ্গ। নানা দেশ ও সেখানকার মাননুষের সঙ্গে পরিচয়ের মধ্য দিয়ে আমরা নানাবিধ অভিজ্ঞতা লাভ করি এবং সেই সঙ্গে নতুন নতুন জ্ঞান আহরণ করি। পৃথিবীর কত যে বিচিত্র স্থান আছে, তার বৈচিত্যের কথা বই পড়ে সবটুকু জানতে পারি না, চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার দ্বারা তা সম্পূর্ণ নতুনভাবে আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কত বিচিত্র দেশ, বিচিত্র তার অধিবাসী-আরো বিচিত্র তাদের সাংস্কৃতি জীবনধারা ও সামাজিক জীবনধারা ও সামাজিক রীতিনীতি। দিকে দিকে কত অরণ্য-সমুদ্র-মরু-পর্বত। নিসর্গ প্রকৃতির কত অফুরান বৈভব, কত পশু-পাখি, জীবজন্তু। আমরা দেশভ্রমণের দ্বারা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সেগুলোকে পূর্ণভা উপলব্ধি করতে পারি। ফলে দেশভ্রমণ শিক্ষার এ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পুঁথির গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ। অধীত-বিদ্যা তাই আমদের মনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে না। তাই দেশভ্রমণ না করলে শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। শিক্ষার সে তার নিক-সম্পর্ক। পাশ্চাত্য দেশে শিক্ষার সে দেশভ্রমণের আত্মার সম্পর্ক। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে দেশভ্রমণের শিক্ষার একটি অঙ্গরূপে প্রতিভাত করা হয় না। গ্রন্থপাঠের মাধ্যমে যে শিক্ষা গ্রহণ করা হয় তার মধ্যে একটি সীমাবদ্ধতা আছে; কিন্তু প্রশ্নের বাইরে জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার দ্বারা যে শিক্ষালাভ হয়, তা সীমাবদ্ধ নয়। এই শিক্ষার জন্যেই দেশভ্রমণের আবশ্যকতা অপরিহার্য।
19. দেশভ্রমণ অতীত ও বর্তমান যুগেঃ যুগপ্রাচীন কাল থেকেই মানুষের মনে ভ্রমণের নেশা। সুদু র অতীতে দেশভ্রমণ ছিল কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সেদিন কোনো সুলভ যানবাহনের ব্যবস্থা ছিল না। যোগাযোগের ব্যবস্থাও ছিল অনুন্নত। অনেক দেশ তখনো ছিল অনাবিষ্কৃত। তবু সেদিনের পথের অনিশ্চয়তা, অশেষ দুর্গতি, জীবন-সংশয়ের আশঙ্কা, কিছুই মানুষকে গৃহবন্দি করে রাখতে পারে নি। সে বেরিয়ে পড়েছে দুর্গম গিরি, কান্তার মরু লঙ্ঘন করার নেশায়। আধুনিক যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতি হয়েছে। উন্নতি হয়েছে পথ ও পরিবহন-ব্যবস্থার। রেল, মোটর, জাহাজ, এরোপ্লেন ইত্যাদির প্রচলনে পথের বাধা-বিপত্তি দু র হয়েছে। তৈরি হয়েছে পর্যটন কর্পোরেশন, ট্যুরিস্ট ব্যুরো, ট্রাভেল এজিন্সির মতো বিভিন্ন সংস্থা। এরা ভ্রমণ-বিনাসীদের সামনে তুলে ধরে বিভিন্ন দ্রষ্টব্য স্থানের বিবরণ, পথের বর্ণনা, যাতায়াত, থাকার সুবিধা, মানচিত্র ইত্যাদির বিচিত্র সংবাদ। ফলে দিনে দিনে ভ্রমণ পিপাসুদের সংখ্যা বেড়েছে।
20.উপসংহার: দেশভ্রমণ পৃথিবীর সকল দেশের সকল শ্রেণীর লোকের মধ্যেই দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। জীবনের জটিলতা যত বাড়বে, বিচিত্র কর্তব্য ও দায়িত্বের বোঝা আমাদের ব্যস্ত ও উদ্বিগ্ন করে তুলবে, একটানা ও একঘেয়ে জীবনের গনির আবর্তের মধ্যে পড়ে আমাদের নিঃশ্বাস যত বন্ধ হয়ে আসবে, ততই ভ্রমণ সম্পর্কে আমরা উৎসাহী হব; দেশভ্রমণের উপযোগিতা ততই বেড়ে চলবে।
21. জলসংরক্ষণ ভূমিকা : আধুনিক জীবন চলছে দ্রুতগতিতে ক্রমবর্ধমান নগরায়ন ও বিশ্বায়নের চাকায় ভর করে। যে জলের দ্বারা সভ্যতার উদ্দ্গমন হয়েছিল, যে জল-কে কেন্দ্র করে জীবন ও জীবিকার বর্ধন সম্ভব হয়েছিল, সেই জলের অভাব আগামী প্রজন্ম-কে ভাবাচ্ছে। পৃথিবীতে তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল হলেও বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব প্রকট হয়ে উঠছে-ভু গর্ভস্থ জল নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার জন্য এবং প্রাকৃতিক জলকে যথাযথভাবে ব্যবহার করার সদিচ্ছা ও সচেতনতার অভাবের জন্য।
22. প্রযুক্তিগত দিক: (ক) প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ঝরনার জলকে সংরক্ষণ করা। (খ) বাড়িতে শৌচালয়ে কম জল লাগে এমন ফ্লাশ ব্যবহার করা। (গ) পানীয় জলের ট্যাপ থেকে নির্গত জলের ব্যবহারে প্রযুক্তি ব্যবহার। (ঘ) বর্জ্য জলকে ব্যবহারযোগ্য করা বা নবীকরণ করা। (ঙ) বহুতল বাড়িতে ছাদের জল পাইপের মাধ্যমে ভূ গর্ভে পাঠানো। (চ) বৃষ্টির জলকে সংরক্ষণ করা। (ছ) উচ্চ দক্ষতার কাপড় ধোয়ার মেশিন ব্যবহার করা। (জ) গাড়ি ধোয়ার কাজে জল ব্যবহার না করা। (ঝ) রাস্তা পরিষ্কারের জন্য জলের ব্যবহারের বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ। (ঞ) হাসপাতালে জলসংরক্ষণের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার। (ট) কৃষিকাজের ওভারহেড সেচ ও ন্যূনতম জল ব্যবহারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। (ঠ) বৃষ্টির জলকে মাটির নীচে ধরেরেখে চাষআবাদ করার নতুন নতুন প্রক্রিয়া গ্রহণ করা যেতে পারে। (ড) সমুদ্রের লবণাক্ত জলকে। মুক্ত করতে সমুদ্রপৃষ্ঠে উদ্ভিদ লাগানো। (ঢ) বালি পরিস্রাবণের মাধ্যমে জল বিশুদ্ধ করাযেতে পারে যে পদ্ধতিতে জীবাণু অপসারিত হতে পারে। (ণ) সর্বোপরি জলের অপচয় রুখতে মানুষকে সচেতন করা। কারণ ভূ গর্ভস্থ স্বাদুজল মাত্র ৩০ শতাংশ।
23. বৃষ্টির জলসংরক্ষণঃ বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করতে পারলে তা যেমন খাবার সময় জল প্রবাহকে বজায় খতে পারবে তেমনি নীচু এলাকাকে বন্যা থেকেও বাঁচানো যাবে। বৃষ্টির জলকে ট্যাংকে ধরে রেখে তাকে পরিশোধন করে ব্যবহার করা যেতে পারে। বৃষ্টির জল আহরণের জন্য জি আই এস ম্যাপ ব্যবহার করে সেই এলাকাকে চিহ্নি করা। যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে কোন এলাকায় জলের চাহিদা কত তা জেনে নিয়ে সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে।
24. উদ্দেশ্য: পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভবিষ্যতের কথা ভেবে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের মানুষের চাহিদা। মেটাতে পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক সম্পদ বিশুদ্ধ জলের পরিমাণ বজায় রাখতে জলসংরক্ষণের বিভিন্ন নীতি ও কৌশল গ্রহণ করেছে। জলসংরক্ষণের উদ্দেশ্য হলঃ (ক) ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিশুদ্ধ জলের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা, (খ) জলকে শক্তিরু পে গণ্য করে তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ, (গ) বিশুদ্ধ জলের উৎসগুলিকে সংরক্ষণ করে, মানুষের জল ব্যবহারের অপচয় কমিয়ে, কৃষিকাজে ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার কমিয়ে আনা।
25. জলসংরক্ষণের উপায়: সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার 'জল ধরো জল ভরো' প্রকল্পের মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছে, যারা দ্বারা গ্রামাঞ্চলে ও শহরে নানা প্রকল্প ও প্রচার ইতিমধ্যে সাড়া জাগিয়েছে। এর জন্য পুকুর ও জলাশয় খনন করে বৃষ্টির জল ধরে রেখে জলাশয় বিস্তার করা, বৃষ্টির জল ধরতে নালা তৈরি করে পরিস্রাবণ পদ্ধতিতে জল ধরে রাখার কৌশল। গ্রহণ করা হয়েছে, যার দ্বারা কৃষিকাজে, বাগানের প্রয়োজনে জলকে ব্যবহার করা যাবে। দীর্ঘদিন ধরে জল চুইয়ে চুইয়ে তা মাটির নীচে প্রবেশ করে। সেই জলেরও দূষণ হচ্ছে স্টোরেজ ট্যাংক, সেপটিক সিস্টেম, বিপজ্জনক বর্জ্যের মাধমে। এজন্য এগুলির যথাযথ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। আর প্রয়োজন জলসংরক্ষণ কৌশলের একটি মৌলিক উপাদান জলসংরক্ষণের উপযোগিতার বার্তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। মানুষের সচেতনতা ও সাবধানতা-ই জলসংরক্ষণ সম্ভাবনার প্রধান উপায়। প্রাকৃতিক শক্তির ব্যবহার এবং ব্যবহৃত শক্তির পুনর্নবীকরণ ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জলসংরক্ষণের যেসব উপায় রয়েছে তার যথাযথ সুষ্ঠ ও আশু ব্যবহার এই মুহূর্তে একান্ত জরুরি। আমরা যদি উপলব্ধি করি তেল ও জল দুই-ই সমান মহার্ঘ, তাহলে তেল সংরক্ষণের মতো জলসংরক্ষণ করার কথা ভাবতে পারি। আর সেই ভাবনা ও ভাবনার যথাযথ রূপায়ণ-ই পারে এই সমস্যার সমাধান করতে।
26. প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞানের ভূমিকা প্রাত্যহিক জীবন ও বিজ্ঞান: বিজ্ঞান ও আধুনিক জীবন সমার্থক। আধুনিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অনিবার্য উপস্থিতি। এদিক থেকে বিজ্ঞান মানুষের প্রতিদিনের সঙ্গী ও বন্ধু। আধুনিক সভ্যতায় বিজ্ঞান এক অপরিহার্য বিষয়। ব্যাবহারিক ও দৈনন্দিন জীবনে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়া আমরা এক পা-ও চলতে পারি না। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত প্রযুক্তিনির্ভর ও জীবনে নানাধরনের যন্ত্রপাতি, বিলাস-উপকরণ ও গেজেট আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। তাকে ছাড়া অমাদের জীবন অচল-অনড় জড়।
27. বিজ্ঞানের দান : বিজ্ঞানীদের অতন্দ্র তপস্যার ফলে আজ বিজ্ঞানের বিজয় বৈজয়ন্তী জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে উড্ডীন। বিজ্ঞান তার জাদুতে মরুকে রূপান্তরিত করেছে সবুজ প্রান্তরে। দুরন্ত নদীর জলধারাকে বন্দি করে ঊষর প্রান্তরে সেই জলধারা দিয়ে জলসেচন করে তাতে সবুজ বিপ্লব ঘটাচ্ছে। বিজ্ঞানের কৃপায় দূর নেই, দূর হয়েছে নিকট। সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে যোগযোগ রক্ষা করা আজ বিজ্ঞানের আবিষ্কার মানুষের জীবনকে অনেক সহজ করে তুলেছে।
28. বিজ্ঞানের দান আমাদের ঘরে ঘরে এবং সর্বত্র: দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের অবদান একান্ত অপরিহার্য। সকালে শয্যাত্যাগ থেকে শুরু করে রাতে শুতে যাওয়ার প্রাক-মুহূর্ত পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি অমাদের সেবায় নিযুক্ত থাকে। দিনের প্রথম পর্বে ঘড়ি আমাদের জানিয়ে দেয় সময়ের সংকেত, রান্নার জন্য ব্যবহৃত হয় গ্যাস বা ইলেকট্রিক ওভেন, কুকিং রেঞ্জ। শীতকালে স্নানের সময় পেয়ে যাই ওয়াটার হিটার। দিনের দ্বিতীয় পর্বে ছাত্রছাত্রী, অফিসযাত্রী সকলেরই নিজ নিজ কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য ট্রাম, বাস, ট্যাক্সি, রেল, চক্ররেল, পাতালরেল, রিকশা, অটোরিকশা, টেম্পো অপেক্ষা করে থাকে। যোগাযোগকে সহজ করেছে টেলিফোন বা দূরভাষ। জরুরি প্রয়োজনে থানা, হাসপাতাল, দমকল প্রভৃতির সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা যায়। আজকাল বহুতল অফিস কাছারিতে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয় না, তার জন্য রয়েছে লিফট বা এসকালেটর। গ্রীষ্মে স্বত্বি দিতে এগিয়ে এসেছে কুলার বা এয়ারকন্ডিশনার। টিভি আর রেডিও ঘরের মধ্যে বিশ্বকে এনে দিয়েছে। অবসর সময় কাটানো ও বিনোদনের প্রধান বাহন আজ এগুলি। তা ছাড়া এই ইলেকট্রনিক প্রচারমাধ্যমে দুটি প্রতি মুহূর্তে সংঘটিত বিশ্ব-ব্যাপারের সঙ্গে আমাদের যুক্ত করে চলেছে। সারাদিনের কর্মক্লান্তির পর মানুষ ঘরে টিভির পর্দায়চোখ রেখে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দেখে ক্লান্তি দূর করে। এভাবেই দিনের শুরু থেকে দিনের শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞান বিশ্বস্তভাবে মানুষের সেবা করে চলেছে।
29. বিনোদনে বিজ্ঞান : বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত উপাদানে গৃহিনী তাঁর রান্নাঘরকে নবসাজে সজ্জিত করার সুযোগ পেয়েছেন। পেনড্রাইভ, মেমরি কার্ড প্রভৃতির দৌলতে ঘরে বসে আমরা ভালোলাগা ছবি দেখার সুযোগ পাচ্ছি, কিংবা গান শুনে মনকে বিষন্নতা থেকে মুক্ত করতে পারছি। এককথায় বিজ্ঞান মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে একাধারে মসৃণ করে তুলেছে।
30. উপসংহার: বর্তমান যুগে মানুষ বিজ্ঞানের আশীর্বাদে, শতদল মাথায় করে জীবনকে করেছে আরামপ্রদ, উপভোগ্য ও সুন্দর। দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনের প্রতিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের নব নব সৃষ্টিকে কাজে লাগিয়েছে মানুষ। বিজ্ঞান দৈনন্দিন জীবনে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। বিজ্ঞান আজ মানুষের বন্ধু, সহযোগী সেবক। দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান আমাদের নিত্য সেবা করে চলেছে। এ কথা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়যে, বিজ্ঞান যদি এত প্রসন্ন না-হত তাহলে এই গতিময় বিশ্বে আমরা বাঁচতাম কী করে।
31.তোমার দেখা একটি মেলার অভিজ্ঞতা সূচনাঃমেলা শব্দটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনে আনন্দের অনুভূতি সৃষ্টি হয়। আক্ষরিকভাবে মেলা শব্দের অর্থ হলো 'মিলন'। মেলায় পরিচিত জনদের সঙ্গে দেখা হয় এবং ভাববিনিময় হয়।
একের সঙ্গে অন্যের সংযোগ ঘটে মেলায়। আমাদের সংস্কৃতিতে মেলার গুরুত্ব অসীম মেলার প্রচলন। অতি প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে মেলার প্রচলন ছিল। তবে তখন মেলার আয়োজন হতে সুনির্দিষ্ট কিছু স্থানে এবং বৃহৎ পরিসরে। বর্তমানে দেশের প্রায় সব স্থানেই মেলা হয়। কোনো কোনোটিক আয়োজন অনেক বড়, আবার কোনোটির ক্ষুদ্র। তবে মেলার আনন্দ এখন আগের মতোই রয়েছে।
32. মেলার উপলক্ষ: আমাদের দেশে বেশির ভাগ মেলা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দুদের দুর্গাপূজা, রথযাত্রা, দোল উৎসব, জন্মাষ্টমী প্রভৃতি উপলক্ষে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মুসলমানদের ১০ই মহরমকে কেন্দ্র করে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বৌদ্ধদের বৌদ্ধপূর্ণিমা উপলক্ষেও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া চৈত্রসংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। আমার দেখা মেলার উপলক্ষ ছিল পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ।
33. মেলার স্থান: সাধারণত খোলা কোনো বৃহৎ স্থানে যেখানে মানুষের চলাচল রয়েছে, তেমন ক স্থানেই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। অনেক সময় স্কুলমাঠেও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। তবে আমি যে মেলাটি দেখেছি, সেটি বসেছিল নদীর ধারের একটি বৃহৎ বটগাছের নিচে।
34. মেলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান : সন্ধ্যার সময় মেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। স্থানীয় শিল্পীদের গান পরিবেশনের পর শুরু হয় যাত্রাপালা। মঞ্চে বেহুলা সুন্দরীর পালা পরিবেশন করা হয়। যাত্রাপালায়। বেহুলা সুন্দরীর জীবনের দুঃখ দেখে অনেকেই আবেগ তারিত হয়ে পড়ে। পরিশেষে সবাইকে ধন্যবাদ। জানিয়ে কর্তৃপক্ষ মেলার ইতি টানে।
35. মেলার তাৎপর্য: মেলায় মানুষের সম্প্রীতির এক বন্ধন তৈরি হয়। স্থানীয়ভাবে তৈরি জিনিসের একটি প্রদর্শনী হয় মেলায়। মানুষ তার নিজস্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারে মেলায় এসে। শুধু তাই নয়, এখানে অর্থনৈতিক বিষয়ও যুক্ত থাকে। একদল মানুষের উপার্জনের মূল উৎস হলো মেলা। এ ছাড়া ক্রেতারাও তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করার জন্য মেলার ওপর নির্ভর করে। অনেকে মেলাকে ঘিরে বছরের বিকিকিনির বড় পরিকল্পনাও করে থাকে।
36. মেলার প্রস্তুতিঃ পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ বাঙালির সবচেয়ে আনন্দের দিন। এদিনকে উপলক্ষ করে মেলার প্রস্তুতিও ছিল বিশাল। অস্থায়ীভাবে বটগাছের চারদিকে দোকানপাট তৈরি করা হয়। একদিকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও যাত্রাপালার জন্য একটি বড় মঞ্চ তৈরি করা হয়। কিছু কিছু মানুষ মূল স্থানে জায়গা না পেয়ে রাস্তার পাশে তাদের জিনিসপত্র নিয়ে বসার প্রস্তুতি নেয়। মঞ্চের চারদিকে মাইক লাগানো হয়।
37. মেলার চিত্রঃ মানুষ রঙিন পোশাক পরে মেলায় প্রবেশ করে। ছোট ছেলেমেয়েদের চোখেমুখে আনন্দের ঝলক দেখা যায়। বৃদ্ধরাও ভিড় এড়িয়ে মেলায় প্রবেশ করতে থাকে। মেলার চারদিকে প্রচন্ড ভিড় লক্ষ্য করা যায়। প্রতিটি দোকানে মানুষ তাদের পছন্দের ও প্রয়োজনের জিনিসপত্র কিনতে শুরু করে। ছোট ছেলেমেয়েরা ভিড় করে মাটির খেলনা, বেলুন, বাশি আরও নানা জিনিসের দোকনে। মেয়েরা ভিড় করে প্রসাধনসামগ্রী ও চুড়ির দোকানে। এখানে গরম জিলিপি কিনতে সবাই ভিড় করে। মেলার একদিকে একটি লোক সাপের খেলা। দেখাচ্ছিল তা দেখতে ভিড় করে অসংখ্য মানুষ। এছাড়া ছোটখাটো একটা সার্কাসের আয়োজনও ছিল।
38. উপসংহার: বাঙালি সংস্কৃতির বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে মেলা। মেলা সাধারণ কোনো আয়োজন নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের প্রথা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য। মেলার মধ্য দিয়ে একশ্রেণির জীবন ও জীবিকা গড়ে উঠেছে। শুধু গ্রামেই নয়, শহরেও মেলা আনন্দের উৎস। তাই তো মেলার দিনে মানুষকে আনন্দ দানের উদ্দেশ্যে সমবেত করতে মেলার কোনো বিকল্প নেই। তাই মেলা আজও আমাদের কাছে এত আকর্ষণীয়।
39. রক্তদান মহান ভূমিকা: "পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি, এ জীবন মন সকলই দাও তার মত সুখ কোথাও কী আছে? আপনার কথা ভুলিয়া যাও।" যুগ যুগান্ত ধরে রক্তদান এমন একটি মহান দান যা মানুষকে ফিরিয়ে দিতে পারে তার প্রান। আজ চিকিৎসাশাস্ত্রে হৃদসংযোজনের দ্বারা জীবনদান সম্ভব হয়েছে ঠিকই কিন্তু কৃত্রিম পদ্ধতিতে রক্ত তৈরী করা এখনও সম্ভব হয়নি। রক্তদান মানুষের নিজের সামর্থে একান্তই চরমতম দান। এর কারণ হল বাজারে সবই পাওয়া যায় টাকা দিয়ে কিন্তু মানুষের রক্ত না। আমাদের সমাজে রক্তের প্রয়োজনীয়তা অসীম। প্রতি মুহূর্তে আমাদের প্রিয়জনদের প্রান বাঁচাতে বা দূর্ঘটনার সময় মানুষদের রক্ত দিয়েই প্রান বাঁচাতে হয় এছাড়াও আমাদের সমাজে অনেক মানুষ আছেন যারা রক্ত সংক্রান্ত নানা জটিল ব্যধিতে আক্রান্ত তাদের এই অসুখে রক্তই একমাত্র জীবনদায়ী ঔষধ। এই রক্ত কোনো কোনো প্রকার যন্ত্রে নয় মানুষের শরিরেই একমাত্র পাওয়া যায় রক্তের বিকল্প আজ পর্যন্ত মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি।
40. 'রক্তের শ্রেণি : মানুষের শরীরে যে রক্ত বইছে তারও প্রকারভেদ আছে। ভিয়েনার প্রখ্যাত চিকিৎসক ল্যান্ড স্টেইনার রক্তে অবস্থিত অ্যন্টিজেন ও অ্যান্টিবডির উপস্থিতি অনুযায়ী রক্তকে মোট চারটি ভাগে ভাগ করেছেন। রক্তের ভাগ গুলি হল , A, B, AB, O এদের প্রত্যেকের পজিটিভ ও নেগেটিভ ভাগ রয়েছে।
41. রক্তের চাহিদা: বিজ্ঞানী হোনস্টোন ১৯১৪ সালে এক পদ্ধতির মাধ্যমে রক্তকে শরীরের বাইরে কিছুদিনের জন্য সংরক্ষণ করতে সমর্থ হন। ১৯১৭সালে কলকাতায় প্রথম ব্লাড ব্যাঙ্ক স্থাপিত হয়। এই ব্লাড ব্যাঙ্ক এ বিশেষ পদ্ধতিতে রক্ত সংরক্ষণ করে রাখা যায়। ভারতে জনসংখ্যার ভিত্তিতে অনেক রক্তের প্রয়োজন। তবে গর্ব আর গৌরবের কথা, যে কাজ মহাদানবীরদের অসাধ্য ছিল এতদিন তা আজ শত শত যুব সমাজ সম্ভব করে দেখিয়েছে। তারা আপন দেহের রক্তদানের মহান সেবায় সজ্জিবীত করেছে জীবন প্রবাহ রক্তই জীবন রক্তই মানুষের প্রানের বিকল্প। মনে রাখা দরকার শরীরের বাড়তি রক্ত শরীরের কোনো প্রকার কাজে লাগে না কিন্তু রক্তদান করার পরে আমাদের শরীরের প্রয়োজনীয় রক্ত খুব তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে যায়। পৃথিবীর সকল দেশেই সচেতন দায়িত্বশীল একদল মানুষ নিয়মিত রক্তদানের মত মহান ব্রতে সামিল হয়েছেন। ফলে অনেক মৃত্যু পথযাত্রী অনেক মানুষ বেঁচে উঠেছেন।
42. রক্তদান: আমাদের সমাজে নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে রক্তদান হয়। কিন্তু রক্তদানের সময় আমাদের ভীষণভাবে রক্তদানকারীর সুস্থতা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কারণ এই রক্তদানের পর সংগৃহীত রক্ত থেকে এইডস প্রভৃতি মরণমুখী দুরারোগ্য ব্যাধিতে মানুষ ভুগছে। তাই রক্তদানের সময় প্রত্যেক মানুষকে ভীষণভাবে সচেতন হতে হবে। কবি তাই সহজে উচ্চারণ করেন-
"এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য
বাষ্পের বেগে ষ্টিমারের মতো চলে,
প্রান দেওয়া নেওয়া ঝুলিটা থাকেনা শূন্য,
সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে।"
43. পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার ভূমিকা: সাধারন ভাবে বলতে গেলে আমাদের চারপাশের ঘরবাড়ি, গাছপালা, নদ-নদী, খাল-বিল, মাটি, বায়ু ইত্যাদি সবকিছুই মিলে তৈরী হয় পরিবেশ। কিন্তু ব্যাপক অর্থে বলতে গেলে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদ ও অনুজীবের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কই হল পরিবেশ।
44. দূষণ কী: আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্মের ফলে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। যেমন- কলকারখানার ধোঁয়া, যানবাহনের ধোঁয়া, ময়লা আবর্জনার ফলে পরিবেশে দূষণের সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবেশের উপাদান: পরিবেশের মোট চারটি উপাদান। যথা- বায়ু, মাটি, জল এবং শব্দ।
45. বায়ুদূষণ: অরণ্য প্রকৃতিকে ধ্বংস করে গড়ে ওঠা নগর সভ্যতা বায়ুদূষণকে আমন্ত্রন জানাচ্ছে। কলকারখানা ও গাড়ি থেকে বেরোনো ধোঁয়া বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই 'গ্লোবাল ওয়ামিং' এর ফলে মেরু প্রদেশের বরফ গলে এর সঙ্গে পারমানবিক শক্তিধর দেশগুলির একাধিক বিস্ফোরণ বাতাসে পারমানবিক তেজস্ক্রিয়তা সৃষ্টি করছে। ফলে ক্যানসার, পঙ্গুত্ব ইত্যাদি অসুখ তীব্রভাবে বেড়ে যাচ্ছে।
47. মাটি দূষণ : জনসংখ্যার হার আমাদের দেশে যেভাবে বেড়ে চলেছে সেই হারে খাদ্য জোগান দেবার জন্য শাক সবজির উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে চাষীরা প্রচুর কীটনাশক দেবার পাশাপাশি নানা বৃদ্ধি মূলক সার দিচ্ছেন, যেগুলি শাকসবজীর সঙ্গে মানবদেহে ঢুকে পাকস্থলীর এবং দেহের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতিসাধন করছে। পাশাপাশি গ্যাস, অম্বল, বদহজম হচ্ছে যা মানুষের বৃদ্ধির অনুপযোগী।
48. শব্দদূষণ : মূলত শহরাঞ্চলে গাড়ির হর্নের তীব্র শব্দ, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাজির শব্দ, মিছিলের শব্দ, মাইকের যথেচ্ছ ব্যবহার ইত্যাদি শব্দ দূষণ সৃষ্টি করে। শব্দদূষণের ভয়াবহতা একদিকে যেমন মানুষের স্থায়ী বধিরতার সৃষ্টি করে, অন্যদিকে হাটস্টক ও স্নায়ুর নানারকম সমস্যা সৃষ্টি করে।
49.জলদূষণ : প্রাচীন সভ্যতা এবং শিল্প সভ্যতারও বিনাশ হয়েছিল নদীতীরবর্তী এলাকায়। কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ, পয়ঃপ্রনালীর অভাবে গ্রামের যাবতীয় বর্জ্য পদার্থ নদীতে মিশে জলদূষণ সৃষ্টি করেছে।
50. পরিবেশ দূষণের প্রতিকার : পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে প্রয়োজন একসাথে লড়াই। সংবাদ মাধ্যমগুলির সাহায্যে দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে বৃক্ষরোপন ইত্যাদি কাজে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সহ সমস্ত স্তরের মানুষকে বিশেষত ছাত্রছাত্রীকে এগিয়ে আসতে হবে।
51. উপসংহার: সমগ্র মানব সমাজকে রক্ষার জন্য পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ অত্যন্ত প্রয়োজন। ৫ জুন তারিখটি বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালিত হয়। কিন্তু শুধু একটি দিন নয়; বছরের প্রত্যেকটা দিন মানুষকে পরিবেশ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। তবেই পরিবেশ দূষণের হাত থেকে মানবজাতি রক্ষা পাবে। পরিবেশকে আরও সুন্দর করে তোলার জন্য মানুষকে শপথ নিতে হবে।
"যতক্ষণ দেহে আছে প্রান
প্রানপনে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল।"
52. জাতীয় সংহতি ভূমিকা: সংহতি হল- একতা, সমন্বয়, অভেদ, নিলন। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ তাই মানুষ এই সংহিত চেতনাকে প্রথমেই বরণ করে নিয়েছিল। কেননা মানুষ কখনই এককভাবে বাঁচতে পারে না। শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, জাতীয় জীবনেও সংহতির একান্ত প্রয়োজন। কেননা জাতীয় সংহতি ছাড়া কোনো জাতির বিকাশ ও অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব নয়।
53. সংহতি অতীত ও বর্তমান: সৃষ্টির আদিতে মানুষ ছিল দুর্বল, কেননা সমাজ নামক সংগঠন তখনও গড়ে ওঠেনি। তখন প্রতিক্ষেত্রেই ছিল তাদের বিপদের সম্ভাবনা। বর্তমানে দেখা যায়, যে জাতি যক একতাবদ্ধ, সেই রাষ্ট্র তত শক্তিশালী। তাই প্রতিটি রাষ্ট্র তাদের নিজেদের সংহতি রক্ষার জন্য সচেষ্ট। কেননা জাতীয় সংহতি ছাড়া জাতির কল্যাণ বা উন্নতি সম্ভব নয়।
54. ভারতের জাতীয় সংহতির স্বরূপঃ প্রাচীনকালে ভারতবর্ষ বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। আধুনিককালে ইংরেজরাই সমস্ত ভারতবর্ষকে এক শাসন সুত্রে গ্রথিত করেছিল। যদিও এই একত্ব ছিল কেবলমাত্র শাসনের জন্য তবুও তার ফলেই পরাধীন ভারতবাসীর মনে গড়ে উঠেচিল এক অখন্ড জাতীয়তাবোধ।
55. সংহতির সংকট: প্রাক্ স্বাধীনতা পর্বে ভারতের দিকে দিকে যে ঐক্য চেতনার ঢেউ উঠেছিল ইংরেজ কুটনীতি সেখানে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করেছিল। অথচ ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতির উৎসই হল সংহতি চেতনা। প্রীতরি রাখী বন্ধনেই হয়েছে এক জাতি এক প্রাণ। বহুর মধ্যে এককে অন্তরতররূপে উপলব্ধিপর মধ্যেই ভারতবাসী খুঁজে পেয়েছে তার জাতীয়তাবোধের বীজমন্ত্র।
ভারতের জাতীয় সংহতি নষ্ট হওয়ার মূল কারণ নিহিত রয়েছে অর্থ নৈতিক বৈষম্যের মধ্যে। এছাড়া বেকারত্বের সমস্যা ভাষা সমস্যা, উন্নয়নমূলক সমস্যা, অশিক্ষা, কুসংস্কার গুলি সংহতির পথে বড়ো বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এইসব সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভ্রান্ত রাজনীতির কার্যকলাপ।
56.. সমাধান : এই সমস্ত সমস্যাগুলি সমাধান করতে না পারলে ভারতের সংহতি বিনষ্ট হবেই। ভাষা সমস্যা, বেকার সমস্যা দূর করতে না পারলে, মানুষের মনে ভবিষ্যৎ সম্বেন্ধ আশা জাগাতে না পারলে ভারতের অগ্রগতির পথে অন্তরায় থেকে যাবেই।
57. উপসংহার: বৈচিত্যের মধ্যে ঐক্যই ভারতবর্ষের চিরন্তন সাধনা। এক জাতি, এক প্রাণ একতার মন্ত্রই ভারতীয় জীবনের বৈশিষ্ট্য আসমুদ্র হিমাচল যে ভারতবর্ষ প্রকৃতির খেয়ালে তাকে একসূত্রে গ্রথিত করেছে, যুগ-যুগান্তর ধরে সেই অখন্ড ভারতবর্ষের সংহতি রক্ষার দায়িত্ব সকলের।
58. একটি নদীর আত্মকথা ভূমিকা: নদীর তীরেই একদিন গড়ে উঠেছিল প্রাচীন সভ্যতা। সিন্ধু নদের ধারে সিন্ধু সভ্যতা, নীলনদের ধারে মিশরীয় সভ্যতা, টাইগ্রীসের ধারে মেসোপটেমিয় সভ্যতা- এমন কতই না উদাহরণ দেওয়া যায়। তোমাদের পুণ্যতোয়া গঙ্গা বা যমুনাও কম যায় না। ইতিহাসের এই অহংকারকে সঙ্গে নিয়েই আমারও এ বয়ে চলা। আমি ইছামতি।
59. আমার বয়ে চলা: আমার উৎপত্তির সঙ্গে যোগ আছে বাংলাদেশের। কুষ্টিয়ার মুনশিগঞ্জের পদ্মার শাখা হিসেবে নদীয়ার মাজদিয়ায় যে মাথাভাঙ ার উদ্ভব ঘটেছে তা-ই দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে -একটি চূর্ণী, অন্যটি আমি। এরপরে কখনও বাংলাদেশ, কখনও ভারতের ভিতর দিয়ে আমার বয়ে চলা। আবার কখনও এপারে ভারত, ওপারে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক জল-সীমান্ত হওয়ায় আমাকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়। এভাবে চলতে চলতেই উত্তর ২৪ পরগণার হাসনাবাদ পেরিয়ে আমি মিশে গেছি রায়মঙ্গলের সঙ্গে। এবার আমার গন্তব্য বঙ্গোপসাগর।
60. আমার গর্ব: দীর্ঘ যাত্রাকালে আমাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থেকেছে কত মানুষ। তাদের কেউ মাছ ধরে, কেউ খেয়া পারাপার করে, কেউ বা কৃষিকাজ । একটা সময়ে আমি ছিলাম যোগাযোগের উপায়।ি নৌকায় করে কত মানুষ এপার থেকে অন্য পারে যাতায়াত করত। আমার মতোই স্বচ্ছল ছিল তাদের জীবন। তোমাদের মানিকবাবু 'পদ্মা নদীর মাঝি'দু লিখেছিলেন, এরকম কত মাঝি-মাল্লার জীবনই তো আমাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়, তোমরা তার খোঁজও রাখো না, কত মাছ খেলে বেড়ায় আমার বুকে চিংড়ি, খয়ড়া, পারশে, আরও কত নাম না জানা মাছ।
জ্যোৎস্নায় যখন ভেসে যায় আমার শরীর সকলে বলে আমি যেন এক রূপবতী কন্যে, আবার সূর্যের প্রথম আলো যখন ছুঁয়ে যায় আমায়, আমি তখন যৌবনদৃপ্ত এক উদ্ভাস। তবে আমার সবথেকে আনন্দের দিন বিজয়া দশমীতে। দুই বাংলা এক হয়ে যায় আমার বুকে। কয়েকশো মানুষ, নৌকায় দেবী প্রতিমা যেন অন্যরকম লাগে নিজেকে। হরেক কিসিমের নৌকা, কোনোটা দানবীয় এবং লঞ্চের থেকেও অনেক বড়ো, আবার পুঁচকে নৌকায় মাঝি- যাত্রীও একজন। যে দুটো তীর সারা বছর প্রায় নীরব থাকে সেখানেই তখন প্রাণের কী উন্মাদনা। নদীতীরে বসে জমজমাট মেলা। তোমাদের রাষ্ট্রনীতি, কূটনীতির শক্ত বিষয়গুলো দূরে সরিয়ে দুটো দেশ প্রাণের বন্ধনে আমারই বুকে মিলে যাচ্ছে- এর থেকে আনন্দের কী হতে পারে।
61. আমার দুঃখ : পলি পড়ে আমার স্বচ্ছন্দ জলস্রোতে আজ অনেকটাই স্তদ্ধ, গতিহীন। পদ্মার সঙ্গে জলস্তরে তারতম্য থাকায় গ্রীষ্মকালে আমার উত্তর দিকে জলের ঘাটতি থাকে। বনগাঁর কাছে ক্ষীণকায়া হতে হতে আমি এখড় প্রায় অদৃশ্য। বসিরহাটেও সেতু তৈরির পরে মজে গিয়ে আমার নাভিশ্বাস অবস্থা। টাকিতে তুলনায় স্বচ্ছন্দ থাকলেও চর জাগছে এখানে ওখানে। অপরিকল্পিত উন্নয়নও আমার এই দুরবস্থার জন্য দায়ী। মাঝে মাঝে ভয় হয়, কত নদীইতো হারিয়েগেল চিরকালের মতো-আমারও না তেমন দশা হয়। শুধু তো চেহারা পাল্টে যাওয়া নয়, সীমান্তরক্ষীদের কঠোর অনুশাসনে নৌকার চলাচল, মাছ ধরা এসবও কমে গিয়েছে। একদিন আমার বুক থেকেভেসে আসত মাঝি মাল্লাদের গান সেসব এখন যেন বিগত জীবনের স্মৃতি। জমিদারের বড়ো বড়ো বজরাগুলোও কালের নিয়মে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে।
62. উপসংহার: দখিনা, বাতাসকে বুকে নিয়ে, দুপাশের জনজীবনের ছবিকে বুক ধরে আজও আমি বয়ে চলেছি। একপাশে আজানের সুর, আরেকদিকে মঙ্গলশাঁখ আজও ধ্বনিময় করে তুলেছে আমার স্রোতধারাকে। আমি ইচ্ছেডানায় ভর করে বয়ে চলা ইছামতি।
No comments:
Post a Comment