❒ লেখক পরিচিতি: জন্ম ১৮৭৬ খ্রিঃ ১৫ সেপ্টেম্বর হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে। তাঁর বাল্যজীবন কাটে বিহারের ভাগলপুরে। পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায়। তিনি দরিদ্রতার জন্য বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারেননি। চাকুরির সন্ধানে রেঙ্গুনে চলে গিয়েছিলেন। ছোটোবেলা থেকে সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। সমাজের অবহেলিত, বঞ্চিত মানুষদের মুখের ভাষাকে তিনি কলমে তুলে ধরেছেন। চরিত্রহীন, শ্রীকান্ত, গৃহদাহ, পথের দাবী, রামের সুমতি, পণ্ডিতমশাই, দেনা পাওনা ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ। ১৯৩৮ খ্রিঃ ১৬ জানুয়ারি এই লেখকের দেহবসান ঘটে।
❒ বিষয় পরিচিতি: আলোচ্য গল্পটি লেখকের 'পল্লীসমাজ' উপন্যাস থেকে নেওয়া হয়েছে। এই গল্পটিতে দেখানো হয়েছে বিষয় সর্বস্ব চিন্তাধারা ও নিষ্ঠুর অর্থলোলুপতার কথা। অপরদিকে ধর্মবোধ ও আত্মমর্যাদা জ্ঞান।'
❐ সারাংশ: জলের বাঁধ না কেটে দিলে একশো বিঘার মাঠ জলের তলায় চলে যাবে। চাষিরা ছুটে গেল গোপাল সরকারের কাছে। আর্জি জানাল বাঁধ কেটে দেওয়ার। রমেশ তক্ষুণি বেণিবাবুর কাছে বাঁধ কাটার জন্য গেল। এতে বেশি কর্ণপাত করলেন না বরং তাঁর জমিদারির ক্ষতি হবে বলে বাঁধ কাটার বিরুদ্ধে ছিলেন এবং হাসি মস্করা শুরু করলেন। রমেশ খুব অনুরোধ করলে বললেন ওরা আবার খাবে কি, ওই জমি তাঁর কাছেই বন্ধক দিতে আসবে জমিদারি তো বাঁচাতে হবে, ওরা ছোটোলোক মরুকগে।
বেণিবাবুর কাছে রমেশ ব্যর্থ হয়ে গেল রমার কাছে। সেখানেও একই অনুরোধ রাখল। রমা এই অনুরোধে চিন্তিতা হয়ে পড়ল।, শেষে সেও বলে দিল এত টাকার মাছ ক্ষতি করতে দেওয়া যাবে না। রমেশ অনেক করে রমাকে বোঝালো কিছুতেই রমা ক্ষতি স্বীকার করতে রাজি হল না। রমেশ তখন তার উপর রেগে গিয়ে কয়েকটি কথা বলতে বাধ্য হল। রমা এতেও কোনো কথা বলল না। হতবাক, তার সম্পর্কে রমেশ হীন নীচ স্বার্থপর বললেও রমা নিশ্চুপ। সব চেষ্টা ব্যর্থ হল দেখে রমেশ চলে গেল।
এদিকে চন্ডীমণ্ডপে আকবর আহত হয়ে বসে আছে। তার দুই ছেলেও আছে। রমাও দেখল এ দৃশ্য। দেখল এটা রমেশেরই কাজ সে বাঁধা দেবার জন্য এদের সঙ্গে লড়াই করেছে, মারামারি করেছে। বেণির হয়ে মারামারি করতে গিয়ে রক্ত বেরুলো তাদের। অথচ বেণি তাদের উপর রাগ করে বললেন, তোমরা বেইমান, ওদের সালাম করে এসেছো। তিন বাপ বেটাই এর প্রতিবাদ করে উঠল। বেণি তাদের থানায় যেতে বললেন। রমা চুপ করে রইল। আকবর বলল সে থানায় যাবে কোন্ লজ্জায়। সদরে গিয়ে গায়ের লাগা চোট সে দেখাতে পারবে না তার মতো সর্দারের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। ক্ষোভে অভিমানে তারা তিন বাপবেটাই সে স্থান ত্যাগ করল। বেণি রাগ করল, কিন্তু রমা নীরব নিথর হয়ে শুরু রমেশের এই নিষ্ঠুরতার কথাই ভাবতে লাগল।
❐ নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন:
❐ সঠিক উত্তরটি নির্বাচন করো: (প্রতিটি প্রশ্নের মান-১)
(ক) আলোচ্য গল্পটির লেখক হলেন (বিদ্যাসাগর/শরৎচন্দ্র/বিভূতিভূষণ)।
উত্তর: আলোচ্য গল্পটির লেখক হলেন শরৎচন্দ্র।
(খ) জমিদার বেণিবাবু বছরে মাছ বিক্রি করে (একশো টাকার/দুশো টাকার/পাঁচশো টাকার)
উত্তর: জমিদার বেণিবাবু বছরে মাছ বিক্রি করে দুশো টাকার।
(গ) দক্ষিণধারের বাঁধটা (ঘোষালদের/মুখুজ্জেদের/ঘোষাল ও মুখুজ্জেদের)
উত্তর: দক্ষিণ ধারের বাঁধটা ঘোষাল ও মুখুজ্জেদের।
(ঘ) খুড়োর মতামতের জন্য কৌতূহল ছিল না (রমেশের/বেণিবাবুর/রমার)
উত্তর: খুড়োর মতামতের জন্য কৌতূহল ছিল না রমেশের।
❐ শূন্যস্থান পূরণ করো: (প্রতিটি প্রশ্নের মান-১)
(ক) একশো বিঘার মাঠটাই এ গ্রামের একমাত্র ----
উত্তর: একশো বিঘার মাঠটাই এ গ্রামের একমাত্র ভরসা।
(খ) মানুষ খাঁটি কিনা, চেনা যায় শুধু ---- সম্পর্কে।
উত্তর : মানুষ খাঁটি কিনা, চেনা যায় শুধু টাকার সম্পর্কে।
(গ) এই দিক দিয়া জল ----- করা যায়।
উত্তর: এই দিক দিয়া জল নিকাশ করা যায়।
(ঘ) তাকে ----- বাজিয়ে এসে এখানে ----- মারা হচ্ছে।
উত্তর: তাকে সেলাম বাজিয়ে এসে এখানে চালাকি মারা হচ্ছে।
❐ বাক্যটির ভুল অংশটি সংশোধন করে লেখো: (প্রতিটি প্রশ্নের মান-১)
(ক) তিনশো বিঘের মাঠ ডুবে গেল।
উত্তর: একশো বিঘের মাঠ ডুবে গেল।
(খ) জল এনে দেবার হুকুম দিন।
উত্তর: জল বার করে দেবার হুকুম দিন।
(গ) বেণির মুখ বিষণ্ণ হইল।
উত্তর: বেণির মুখ গম্ভীর হইল।
(ঙ) মোরা লড়াই করতে পারব না।
উত্তর: মোরা নালিশ করতে পারব না।
(ঘ) আকবর হাত কাটিয়া বলিল।
উত্তর: আকবর জিভ কাটিয়া বলিল।
❐ অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন (দু-একটি কথায় উত্তর দাও): (প্রতিটি প্রশ্নের মান-১)
(ক) জমিদার বেণিবাবু বছরে কত টাকা মাছ বিক্রি করতেন?
উত্তর: জমিদার বেণিবাবু বছরে দুশো টাকার মাছ বিক্রি করতেন।
(খ) 'তোমাকে নিষ্ঠুর বলাও ভুল'-উক্তিটি কে. কাকে করেছিল?
উত্তর: উক্তিটি রমেশ রমাকে করেছিল।
(গ) 'এই জল-কাদায় সন্ধ্যার পর কোথায় যাস'-উক্তিটি কে, কাকে করেছিল? উদ্দিষ্ট ব্যক্তি কোথায় যাচ্ছিল?
উত্তর: উক্তিটি মাসি রমাকে করিয়াছিল। উদ্দিষ্ট ব্যক্তি (রমা) বড়দা অর্থাৎ বেণিবাবুর কাছে গিয়েছিল।
(ঘ) 'বেইমান কয়ো না'-কে কাকে কেন বলেছিল?
উত্তর: উক্তিটি আকবর বেণিবাবুকে বলেছিল।
রমার আদেশে আকবর রমেশের বাঁধ কাটা আটকাতে গিয়ে অসমর্থ হয়ে ফিরে এসে রমেশের প্রশংসা করায় বেণিবাবু তাকে বেইমান বলেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আকবর বেণিবাবুকে এই কথা বলে।
(ঙ) বাঁধ পাহারা দেবার জন্য রমা কাকে পাঠিয়েছিল?
উত্তর: বাঁধ পাহারা দেবার জন্য রমা তাদের প্রজা আকবর ও তার দুই পুত্রকে পাঠিয়েছিল।
(চ) গোপাল সরকার রমেশকে কোন্ ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল?
উত্তর: গ্রামের গরিব চাষিদের একমাত্র ভরসা একশো বিঘের মাঠটা। কিন্তু বৃষ্টির জল জমে এই মাঠের সমস্ত ফসল নষ্ট হতে বসেছে। এই অবস্থায় বাঁধ না কেটে দিলে চাষিদের সমস্ত ফসল নষ্ট হয়ে যাবে।
এই কথাটাই গোপাল সরকার রমেশকে বুঝিয়ে বলল।
(ছ) চাষিরা রমেশের কাছে কী জানাতে এসেছিল?
উত্তর: একশো বিঘের মাঠ ডুবে যাবে, জল বার করে না দিলে সমস্ত ধান নষ্ট হয়ে যাবে। গাঁয়ে একটা ঘরও খেতে পাবে না। এই কথাই চাষিরা রমেশের কাছে জানাতে এসেছিল।
(জ) রমেশ বেণির কাছে কেন গিয়েছিল?
উত্তর: একশো বিঘের মাঠের দক্ষিণ ধারের বাঁধটা কেটে দিলে জল নিকাশ হয়ে যাবে, ফসল রক্ষা পাবে। এই বাঁধ কেটে দেবার প্রস্তাব নিয়ে রমেশ বেণির কাছে গিয়েছিল।
❐ সংক্ষিপ্ত প্রশ্নঃ (প্রতিটি প্রশ্নের মান-৩)
(ক) "মানুষ খাঁটি কিনা চেনা যায় শুধু টাকার সম্পর্কে"- কে কার উদ্দেশ্যে এই উক্তি করেছে? বক্তার এরূপ উক্তি করার কারণ কী তা সংক্ষেপে বুঝিয়ে দাও।
উত্তর: রমেশ রমার সম্পর্কে এই উক্তি করেছে। গ্রামের লোকের একশো বিঘের মাঠটাই প্রাণ। গ্রামের সমস্ত মানুষ ঐ মাঠে উৎপন্ন ফসলের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু আলোচ্য ঘটনার সময় আমরা দেখি যে মাঠটি বর্ষার জলে পরিপূর্ণ, ফসল নষ্ট হতে বসেছে। এই অবস্থায় মাঠের দক্ষিণদিকের বাঁধটা কেটে না দিলে সমস্ত ফসল নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু তাতে বাঁধের গায়ে যে জল আছে তার সমস্ত মাছ বাঁধের জলের সঙ্গে বেরিয়ে যাবে যাতে ঘোষাল ও মুখুজ্জেদের দু-তিনশো টাকা ক্ষতি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বেণিবাবু বাঁধ কাটতে রাজি না হওয়ায় রমেশ রমার কাছে উপস্থিত হলো। এবং বাঁধ কাটার আবেদন করলেন। রমা তাতে রাজি হলো না। রমেশ মিনতি কণ্ঠে কহিল এই দু-তিনশো টাকা ক্ষতি হলে তোমাদের কিছুই হবে না। কারণ গ্রামের সকল মানুষের থেকে তোমাদের অবস্থা ভালো। সামান্য টাকার জন্য গ্রামের এত লোকের অন্ন কষ্ট দিও না এই কথা শুনে রমা বলল আপনার যদি এত দয়া হয় তাহলে তুমি নিজেই ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিও। সেই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতেই রমেশ রমাকে এই কথা বলে।
(খ) “দেখবে ব্যাটারা যে যার জমি বন্ধক রেখে আমাদের কাছেই টাকা ধার করতে ছুটে আসবে।"-অংশটি কার লেখা কোন্ গল্প থেকে গৃহীত হয়েছে? উক্তিটির মধ্যে বক্তার কোন্ চরিত্রের দিক ফুটে উঠেছে?
উত্তর: অংশটি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত পল্লীসমাজ গল্প থকে গৃহীত হয়েছে। উক্তিটি করেছেন বেণিবাবু। তিনি গ্রামের জমিদার। প্রজারা তাঁর ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বৃষ্টির জল জমে মাঠের সমস্ত ফসল নষ্ট হয়ে যাবে একথা জেনেও তিনি নির্বিকার। কারণ তিনি জানেন বাঁধ কাটলে তার সংলগ্ন জল থেকে সমস্ত মাছ বেরিয়ে যাবে। এর ফলে তার দু-তিনশো টাকা লোকসান হবে। তাই প্রজাদের পাঁচ সাত হাজার টাকার ক্ষতি হবে এবং সারা বছরের অর্থ নষ্ট হবে। রমেশের এইসব যুক্তিতেও তিনি বাঁধ না কাটার সংকল্পে অনড় থাকেন। 'এই ঘটনার বর্ণনায় তাঁর লোভী, স্বার্থপর এবং জমিদার হিসাবে প্রজাদের প্রতি দায়িত্বশীলতার অভাব সম্বলিত চিত্রটাই আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে।
(গ) "হ্যাঁ-মায়ের দুধ খেয়েছিল বটে ছোটোবাবু, লাঠি ধরলে বটে।"-কার উক্তি? ছোটোবাবু কে? তাকে লাঠি ধরতে হয়েছিল কেন?
উত্তর: উক্তিটি পিরপুরের প্রজা লাঠিয়াল আকবরের ছোটোবাবু অর্থাৎ পিরপুরের জমিদার বেণিবাবুর ভাই রমেশের কথা বলা হয়েছে।
পিরপুর গ্রামের একশো বিঘের মাঠটাই গ্রামের প্রাণ। সেই মাঠে উৎপন্ন ফসল থেকে গ্রামের গরিব প্রজারা অর্থ ও অন্ন দুই-ই পায়। আলোচ্য অংশে আমরা দেখি যে জল জমে মাঠের সমস্ত ফসল নষ্ট হতে বসেছে। অথচ জমিদার হিসাবে বেণিবাবু প্রজাদের প্রতি কোনো কর্তব্য করছেন না কারণ জমির বাঁধ কাটলে তার সংলগ্ন জলা থেকে বেরিয়ে যাবে সব মাছ যা থেকে বেণিবাবুর আয় প্রায় দুশো টাকা। প্রজাদের পক্ষ থেকে রমেশ বাঁধ কাটার প্রস্তাব নিয়ে বেণিবাবুর কাছে বিফল ও ক্ষুব্ধ হয়ে যায় রমার কাছে। কিন্তু তিনিও বাঁধ না কাটার সিদ্ধান্তে অবিচল। রমেশের সঙ্গে তিক্ত আলাপ আলোচনায় ক্ষুব্ধ হয়ে রমা গ্রামের প্রজা লাঠিয়ালকে পাঠায় বাঁধ পাহারা দিতে। কিন্তু রমেশ যে কত ভালো লাঠিয়াল সে সম্পর্কে কারোরই সম্যক ধারণা ছিল না। লাঠিয়াল আকবর ও তার দুই ছেলে রমেশের লাঠির আঘাতে আহত হয়। সেই বর্ণনা প্রসঙ্গে আকবর এই উক্তিটি করে।
(ঘ) "তুমি যে এত নিষ্ঠুর হতে পার, আমি তা স্বপ্নেও ভাবিনি"-এটা কার উক্তি? সে এরকম নিষ্ঠুর হয়েছিল কেন? বক্তা কী ভেবেছিলেন?
উত্তর: গ্রামের প্রাণ একশো বিঘার মাঠ। গরিব চাষিদের সারাবছরের অর্থ ও অন্ন জোগায় এই মাঠের ফসল। কিন্তু জল জমে মাঠের সমস্ত ফসল নষ্ট হতে বসেছে। একমাত্র উপায় মাঠের দক্ষিণধারে জমিদারদের যে বাঁধটা রয়েছে সেটা কেটে দেওয়া। কিন্তু এই বাঁধ কাটলে তার সংলগ্ন জলা থেকে সমস্ত মাছ বেরিয়ে যাবে যাতে জমিদারদের প্রায় দু-তিনশো টাকা লোকসান হবে। তাই জমিদাররা বাঁধ কাটতে নারাজ। রমেশের আবেদন বেণিবাবু নির্দ্বিদায় খারিজ করে দেন। ফলে রমেশ শরণাপন্ন হয় দ্বিতীয় শরিক রমার। কিন্তু রমাও বেণিবাবুর পথেরই পন্থী। প্রজাদের পাঁচসাত হাজার টাকার ক্ষতি যা সারাবছরের অর্থের বিনিময়ে জমিদার পক্ষের দু-তিনশো টাকার বিপুল ক্ষতি স্বীকার করতে তিনি কোনোমতেই রাজি নন। তাই তিনি নিষ্ঠুরভাবে রমেশের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
বক্তার ধারণা ছিল কোনো এক অজ্ঞাত কারণে রমা তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না। বাঁধ কাটার বিষয়ে সে রমেশের সঙ্গে সহমত হবে।
(ঙ) "বাঁধ কেটে না দিলে সারা গাঁয়ের লোক মারা পড়বে তাই কাটতেই হবে।"-কে, কাকে এই কথা বলেছেন? যাকে উদ্দেশ্য করে একথা বলা হয়েছে তার পরিচয় দাও।
উত্তর: বেণীবাবু পিরপুরের প্রজা লাঠিয়াল এর জোরে আগেকার দিনে অনেক বিষয় সম্পত্তি হস্তগত করেছিল। রমা বাঁধ পাহারা দেবার জন্য আকবরকে পাঠিয়েছিল। আকবর ও তার দুই পুত্র রমেশকে প্রাণপণে বাধা দিয়ে শেষ রক্ষা করতে পারেনি। আকবর আহত হয়ে মুখে কাঁচা রক্ত জমাট বাঁধিয়া বেণির বাড়িতে এলো তখন বেণি আকবরকে থানায় গিয়ে চাষিদের নামে অভিযোগ জানানোর কথা বললে আকবর রাজি হয় নাই। কারণ আকবর জানে বাঁধ কেটে না দিলে চাষিরা সারা বছর না খেয়ে মরবে। এখানে তিনি মানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন। বেণি রেগে গিয়ে বলে আকবর তুই ওদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে বাঁধ কাটার সুযোগ করে দিয়েছিস। এই কথা শুনে আকবর বলে আমরা বেইমান নই। আমরা গরিব হতে পারি কিন্তু কাজের দায়িত্ব নিয়ে অধর্ম কাজ করি না। এখানে আকবর ও তার দুই ছেলে নিজের ধর্মের ও দায়িত্বে অবিচল ছিলেন।
❐ রচনাধর্মী প্রশ্ন: (প্রতিটি প্রশ্নের মান-৫)
(ক) "ব্যাপারটা রমেশকে বুঝাইয়া দিল।"-রমেশকে কে বুঝিয়েছিল? 'ব্যাপারটা' বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: ব্যাপারটা রমেশকে পিরপুর গ্রামের সরকার বুঝিয়ে দিল। একশো বিঘের মাঠটির পূর্বদিকে সরকারি বাঁধ, পশ্চিম ও উত্তর পাড়ে চট্টগ্রাম ও দক্ষিণদিকে ঘোষাল ও মুখুজ্জেদের বাঁধ। এই বাঁধটির সঙ্গে সংলগ্ন রয়েছে একটি জলা, যার মাছ বিক্রি করে জমিদাররা বছরে দুশো টাকা লাভ করে। তাই জলার ধারে রয়েছে কড়া পাহারা। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সে সময়ে এই একশো বিঘের মাঠটি জলপূর্ণ হয়ে গেছে। সমস্ত ফসল নষ্ট হতে বসেছে। কেবলমাত্র দক্ষিণদিকের বাঁধটা কেটে জল বের করে দিলেই ফসল রক্ষা হয়। তবে তাতে মুশকিল এই যে জালার সমস্ত মাছও জলের সঙ্গে বেরিয়ে যাবে। তাই বেণিবাবু বাঁধ কাটতে নারাজ। চাষিরা তার কাছে ধরনা-দিয়ে কোনো উত্তর না পেয়ে রমেশের কাছে এসেছে। গোপাল সরকার এই বিষয়টাই রমেশকে বুঝিয়ে দিলেন।
(খ) 'জল বার করে দেবার হুকুম দিন।'-বক্তা কে? কাকে কখন একথা বলা হয়েছে? জল বার করে দেবার প্রয়োজন হয়েছিল কেন?
উত্তর: বক্তা রমেশ। কথাটা বেণিবাবুকে বলা হয়েছে।
চাষিদের কাছে একশো বিঘের মাঠের অবস্থা শুনে রমেশ সন্ধ্যায় বেণিবাবুর কাছে যায় এই কথা বলার জন্য।
একশো বিঘের মাঠের ফসল পিরপুর গ্রামের প্রজাদের প্রাণস্বরূপ। সেই ফসল তাদের সারাবছরের অর্থ ও অন্ন জোগায়। কিন্তু আলোচ্য বছরে একশো বিঘের মাঠে জল জমে সমস্ত ফসল নষ্ট হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। এই অবস্থা থেকে নিস্তার পাবার একমাত্র উপায় হল মাঠের দক্ষিণধারে ঘোষাল ও মুখুজ্জেদের বাঁধটা কেটে জমির জল বার করে দেওয়া। কারণ পূর্বদিকের বাঁধটা সরকারি আর উত্তর পশ্চিমদিকে উঁচুগ্রাম। কাজেই দক্ষিণদিকেই বাঁধ কেটে জল নিকাশ ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। জল জমে ফসল নষ্ট হলে চাষিদের পাঁচ-সাত হাজার টাকা বরং সারাবছরের অর্থ নষ্ট হয়ে যাবে। তাই বাঁধ কাটার প্রয়োজন হয়েছিল।
(গ) এরা সারাবছর খাবে কী? কে কাকে একথা বলেছেন? একথা কেন বলা হয়েছে?
উত্তর: একথা রমেশ বলেছেন বেণিবাবুকে।
গ্রামের প্রাণস্বরূপ একশো বিঘের মাঠটা। এই মাঠের উৎপন্ন ফসল থেকেই গ্রামের গরিব চাষিরা পাঁচসাত হাজার টাকা রোজগার করে, তাদের সারা বছরের অর্থ সংস্থান হয়। যে সময়ের ঘটনা আলোচ্য অংশে বর্ণনা করা হয়েছে তাতে আমরা দেখি যে এই একশো বিঘের মাঠ এমনই জলে ভরে গেছে যে সমস্ত ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই মাঠের পূর্বদিকে সরকারি বাঁধ, উত্তর ও পশ্চিমে গ্রাম আর দক্ষিণে জমিদারের বাঁধ। এই বাঁধ কেটে মাঠের জল বার করে দিলে তবেই মাঠের ফসল বাঁচে, গরিব চাষিদের অন্নসংস্থান হয়। বেণিবাবুর কাছে সারাদিন আবেদন-নিবেদন করে কোনো সাড়া না পেয়ে তারা যায় রমেশের কাছে। চাষিদের কথা শুনে সমস্ত পরিস্থিতি বিবেচনা করে চাষিদের পক্ষ থেকে রমেশ বেণিবাবুর কাছে যায় বাঁধ কেটে দেবার প্রস্তাব নিয়ে। রমেশ ও বেণিবাবুর আলোচনার মধ্যে রমেশ বেণিবাবুকে এই কথা বলে।
(ঘ) "তোমার পারো আটকাবার চেষ্টা করো গে।"-কে, কোন্ প্রসঙ্গে এই উক্তি করেছে? কাদের উদ্দেশ্যে করেছে? বক্তার চরিত্রের কোন্ দিকটা এখানে প্রকাশিত হয়েছে?
উত্তর: উক্তিটি রমেশের। জলপূর্ণ একশো বিঘের মাঠের ফসল বাঁচাবার একমাত্র উপায় দক্ষিণদিকের জমিদারদের বাঁধটা কেটে দেওয়া, কারণ পূর্বদিকের বিরাট বাঁধটা সরকারি সেটা কাটা সম্ভব নয়, আর পশ্চিম ও উত্তর দিকে রয়েছে গ্রাম। কাজেই দক্ষিণের বাঁধটা কাটা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু জমিদার নারাজ। কারণ বাঁধ কাটলে বাঁধের সংলগ্ন জলা থেকে সমস্ত মাছ বেরিয়ে গিয়ে প্রায় দু-তিনশো টাকা লোকসান হয়ে যাবে জমিদারের। তাই জমিদার বাঁধ কাটতে রাজি নন। রমেশ বেণিবাবুর কাছে আবেদন করে ব্যর্থ হয়ে যায় অন্য শরিক রমার কাছে। রমাও বাঁধ কাটার অনুমতি না দেওয়ায় তার সঙ্গে বাক্য বিনিময়ের মধ্যে রমেশ এই উক্তিটি করে।
রমেশ এই কথাগুলি রমাকে বললেও সেটা কেবলমাত্র রমাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়নি। যেহেতু এই জমিদারির মালিকানায় রমা ও বেণিবাবু দুজনেই অংশীদার এবং বাঁধ কাটার বিষয়ে দুজনে একই মত পোষণ করে, সেই কারণে কথাগুলি রমাকে বলা হলেও 'তোমরা' বলতে এখানে রমা, বেণিবাবু ও সমগ্র জমিদারকেই বোঝানো হয়েছে। এই উক্তিটির মধ্য দিয়ে বক্তার চরিত্রের কোমল সংবেদনশীল অথচ দৃঢ়চেতা ফুটে উঠেছে। কাহিনীর শুরুতে আমরা দেখি যে গরিব চাষিরা তাদের ফসল বাঁচাবার জন্য বেণিবাবুর কাছে আবেদন করে বিফল হয়ে রমেশের কাছে এসেছে। তাদের মুখে সমগ্র কাহিনী শুনে রমেশ তাদের পক্ষ নিয়ে বেণিবাবুর কাছে যায়। অর্থাৎ গরিবদের প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীল ও সহকর্মী। আবেদন নিবেদন ব্যর্থ হয়ে সে যায় দ্বিতীয় শরিক রমার কাছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় রমাও এ ব্যাপারে একই মত পোষণ করে। সেক্ষেত্রেও কিন্তু আমরা দেখি যে রমার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কে থাকা সত্ত্বেও এই বিষয়ের আলোচনা সে ব্যক্তিগত কোনো প্রসঙ্গ আসতে দেয়নি। গরিব চাষিদের পক্ষে সে অচল।
আর চারিত্রিক দৃঢ়তা এখানে স্পষ্ট। কাহিনীর অন্য অংশে দেখি গ্রামের মানুষের জন্য রমেশ রাস্তা বাঁধিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ জমিদারসুলভ দায়িত্ববোধও তার মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান। এককথায় বলতে গেলে মমতা দায়িত্ববোধ সংবেদনশীলতার সঙ্গে দৃঢ়তার সংমিশ্রণে রমেশ এক আদর্শ চরিত্র।
(ঙ) রমেশ ও বেণির চরিত্রগত পার্থক্য সংক্ষেপে আলোচনা করো।
উত্তর: আলোচ্য পাঠ্যাংশের বিশ্লেষণ করলে সহজে বেণি ও রমেশের চরিত্রগত বৈপরীত্য আমাদের চোখে পড়ে। বাঁধের জল কেটে ফসল বাঁচানো প্রয়োজন অথচ বাঁধ কাটলে জলার সমস্ত মাছ বেরিয়ে গিয়ে জমিদারি অনেক টাকা লোকসান হবে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিবাদের উৎপত্তি। বেণবাবু জানতেন জল জমে একশো বিঘা জমির ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তিনি নির্বিকার। গরিব চাষি প্রজাদের আর্থিক ক্ষতি বা অন্নসংস্থানের অসুবিধের প্রতি তার কোনো দৃষ্টি নেই। বাঁধ কাটলে জলার মাছ বেরিয়ে গিয়ে দু-তিনশো টাকার ক্ষতি হতে পারে এই বিষয়ে তিনি বেশি চিন্তিত। অর্থাৎ জমিদার হিসাবে প্রজাদের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র দৃষ্টি নেই প্রজাদের কান্না তার কানে পৌঁছায় না। তিনি অত্যন্ত স্বার্থপরতার সঙ্গে কেবল মাছ বেরিয়ে যাওয়ার লোকসান নিয়েই চিন্তিত থাকেন।
অপরপক্ষে আমরা দেখি যে রমেশের কানে জল জমার খবর পৌঁছানো মাত্রই তিনি তৎপর হন প্রজাদের স্বার্থে। বেণিবাবুর কাছে আবেদন করেন বাঁধ কেটে দেবার জন্য। বেণিবাবুর স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক চরিত্রের পাশাপাশি রমেশের সংবেদনশীল চরিত্রকে আমরা প্রজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখি।
বেণিবাবুর সঙ্গে আলোচনা সার্থক না হওয়ায় রমেশ যায় অন্য শরিক রমার কাছে। কিন্তু রমাও বেণিবাবুর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্র ধরে রমেশের কাছেই চাষিদের ক্ষতিপূরণ দাবি করে। এখানে আমরা আবার বেণিবাবুর তুলনায় রমেশের চরিত্রের মহত্ত্ব দেখতে পাই। ব্যক্তিগত সম্পর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে সে কেবলমাত্র গ্রামের গরিব প্রজাদের স্বার্থেই নিজের কাজের পরিকল্পনা করে, নিজের দায়িত্বে বাঁধ কাটার সিদ্ধান্ত রমাকে জানিয়ে দেয়। এই সংবেদনশীল পরার্থপরতা নিশ্চিতভাবেই রমেশকে বেণিবাবুর তুলনায় এক উজ্জ্বল আসনে প্রতিষ্ঠা করে। এবং ঘটনার শেষে যখন আমরা দেখি যে রমার প্রেরিত লাঠিয়ালেরও সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছে তখন এ বিষয়ে আর সন্দেহ থাকে না যে উদারতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, সহানুভূতিশীলতা সব গুণেই সে বেণিবাবুর তুলনায় অনেক উচ্চতায় অধিষ্ঠিত।
❐ ব্যাকরণ:
(ক) সমাস নির্ণয় করো: অবিশ্রান্ত, অপরাহ্ন, চণ্ডীমণ্ডপ, হিসাবপত্র, মড়াকান্না, প্রাণপণ হতবুদ্ধি।
উত্তর: অবিশ্রান্ত = নয় শ্রান্ত-না বা নঞ তৎপুরুষ সমাস।
অপরাহ্ন = অহনের পর-সম্বন্ধ তৎপুরুষ সমাস।
চন্ডীমণ্ডপ = চন্ডীর মণ্ডপ-সম্বন্ধ তৎপুরুষ সমাস।
হিসাবপত্র = হিসাব ও পত্র-দ্বন্দু সমাস।
মড়াকান্না = মড়ার জন্য কান্না-নিমিত্ত তৎপুরুষ সমাস।
প্রাণপণ = প্রাণের নিমিত্ত পণ-নিমিত্ত তৎপুরুষ সমাস।
হতবুদ্ধি = হতবুদ্ধি যার-বহুব্রীহি সমাস।
(খ) কারক বিভক্তি নির্ণয় করো: ক্ষোভে রমেশের চোখমুখ উত্তপ্ত হইয়া উঠিল।
উত্তর: ক্ষোভে-করণ কারকে 'এ' বিভক্তি।
চোখমুখ-কর্মকারকে 'শূন্য' বিভক্তি।
রমেশের-কর্তৃকারকে 'এর' বিভক্তি।
(গ) পদান্তর করো: মৃদু, অনুরোধ, ক্রুদ্ধ, আহত, গম্ভীর, রাগ, বিনীত, উত্তপ্ত, শান্ত, উপস্থিত।
উত্তর: মৃদু-মৃদুতা।
গম্ভীর-গাম্ভীর্য।
শান্ত-শান্তি।
অনুরোধ-অনুকূল।
রাগ-রাগী।
উপস্থিত-উপস্থিতি।
কুদ্ধ-ক্রোধ।
বিনীত-বিনয়।
আহত-আঘাত।
উত্তপ্ত-উত্তপ্ততা।
(ঘ) সন্ধি বিচ্ছেদ করো: অপরাহ্ন, অপেক্ষা, মহাশয়, রমেশ, অর্ধেক, পৌঢ়।
উত্তর: অপরাহ্ন = অপ অহ্ন।
মহাশয় = মহা আশয়।
অর্ধেক = অর্ধ এক।
অপেক্ষা = অপ+ ইক্ষা।
রমেশ রমা+ ইশ।
প্রৌঢ় = প্রো + উঢ়।
No comments:
Post a Comment