আমরা কবিতার প্রশ্ন উত্তর নবম শ্রেণি বাংলা | নবম শ্রেনীর বাংলা প্রশ্ন উত্তর | Class 9th Bangla Amar Question and Answers (MCQ, SAQ, DAQ) - Psycho Principal

Fresh Topics

Wednesday, 23 April 2025

আমরা কবিতার প্রশ্ন উত্তর নবম শ্রেণি বাংলা | নবম শ্রেনীর বাংলা প্রশ্ন উত্তর | Class 9th Bangla Amar Question and Answers (MCQ, SAQ, DAQ)

 


আমরা কবিতার 
প্রশ্ন উত্তর







❐ কমবেশি ১৫টি শব্দের মধ্যে উত্তর দাও :


1. 'আমরা' কবিতাটি কার লেখা?

উত্তরঃ  'আমরা' কবিতাটি কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা।


2. বাঙালি কোথায় বাস করে?

উত্তরঃ  মুক্তধারার গঙ্গা যেখানে মুক্তি বিতরণ করে, সেই পুণ্য বরদাত্রী তীর্থভূমি বাংলায় বাঙালি বাস করে।


3. বঙ্গভূমির বাম ও ডান হাতে এবং শিয়রে কী কী শোভা পাচ্ছ?

উত্তরঃ  বঙ্গভূমির বামহাতে কমলার ফুল; ডানহাতে মধুক-মালা আর শিয়রে কাঞ্চন-শৃঙ্গ-মুকুট শোভা পাচ্ছে।


4. 'কাঞ্চন-শৃঙ্গ-মুকুট' বলতে কী বোঝ?

উত্তরঃ  বাংলার উত্তরে তুষার আবৃত হিমালয়ের ওপর সূর্যের কিরণ পড়ে সোনার রং ধারণ করে। কবি একেই বাংলা মায়ের কপালে কাঞ্চন-শৃঙ্গ-মুকুট বলে বর্ণনা করেছেন।


5.  'কিরণে ভুবন আলা'-কথাটির অর্থ কী?

উত্তরঃ  বাংলা মায়ের কপালের কাঞ্চন-শৃঙ্গ-মুকুট থেকে সোনার মতো দীপ্তিমান প্রভায় আলোকে আলোকিত জগৎকে বোঝানো হয়েছে।


6. বঙ্গদেশের কোলে ও বুকে কী কী আছে?

উত্তরঃ  বঙ্গদেশের কোলে কনক ধান্য এবং বুকে সন্তানের জন্য বর্ষিত অপার স্নেহ-সুধা আছে বলে কবি মনে করেছেন।


7.  অতসী-অপরাজিতায় কার দেহ ভূষিত?

উত্তরঃ  কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের 'আমরা' কবিতায় বঙ্গভূমির দেহ অতসী-অপরাজিতায় ভূষিত।


8.  কে বঙ্গভূমির বন্দনা গান করে?

উত্তরঃ  বঙ্গদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর যেন প্রতিনিয়ত শত তরঙ্গ ভঙ্গে বঙ্গমাতার বন্দনা গান গেয়ে চলে।


9.  আমরা কার সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছি?

উত্তরঃ  আমরা বাঙালিরা সুন্দরবনের গভীরে হিংস্র বাঘের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছি।


10.  নাগের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক কেমন?

উত্তরঃ  'আমরা' কবিতায় নাগের সঙ্গে মানুষের যে সহজ সম্পর্কের কথা কবি বলেছেন তা থেকে আমরা বাঙালিরা যে-কোনো প্রতিকূলতাকে জয় করতে পারি সেকথাই কবি বুঝিয়েছেন।


11.  আমাদের সেনা কার সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল?

উত্তরঃ  'আমরা' কবিতা অনুসারে বাঙালি-সেনা চতুরঙ্গে সজ্জিত হয়ে দশাননজয়ী রামচন্দ্রের প্রপিতামহ রঘুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল।


12.  'চতুরঙ্গ' কী?

উত্তরঃ  হাতি, ঘোড়া, রথ ও পদাতিক-এই চার প্রকার বাহিনী সমন্বিত রণবহরকে চতুরঙ্গ বলে।


13. 'নিজ শৌর্যের পরিচয়'- কে, কীভাবে শৌর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন?

উত্তরঃ  বাংলার ছেলে বিজয়সিংহ লঙ্কাদ্বীপ জয় করে, তার নামের সঙ্গে নিজের নাম যোগ করে 'সিংহল' নাম রেখে শৌর্যের পরিচয় দিয়েছেন।


14.  'একহাতে মোরা মগেরে বুখেছি'- বলার কারণ কী?

উত্তরঃ  সেকালে আরাকানের অধিবাসী মগদস্যুরা সুন্দরবন, নোয়াখালি, খুলনা, চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নির্মম অত্যাচার ও বর্বরতা চালাত। বাঙালিরা তাদের সঙ্গে লড়াই করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল।


15. দিল্লিনাথকে কে প্রতিহত করেছিলেন?

উত্তরঃ  দিল্লিনাথ আকবর ও জাহাঙ্গিরকে যুদ্ধে প্রতিহত করেছিলেন বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম অসমসাহসী প্রতাপাদিত্য রায় ও চাঁদ রায়।


16.  কপিলমুনি কে ছিলেন?

উত্তরঃ পুরাণ মতে, কর্দম প্রজাপতি ও দেবাহুতির সন্তান ঋষি কপিল হলেন সাংখ্যদর্শন প্রণেতা। কবি তাঁকে আদিবিদ্বান ও পরম জ্ঞানী বলে অভিহিত করেছেন।


17.  'বাঙালি অতীশ লঙ্ঘিল গিরি তুষারে ভয়ংকর,'- বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?

উত্তরঃ  বাংলার বিক্রমশীলা মহাবিহার থেকে তুষারাবৃত তিব্বতে গিয়ে অতীশ দীপঙ্কর জ্ঞানপ্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন। তিব্বতিদের কাছে তিনি বুদ্ধের অবতাররূপেই পূজিত হন।


18. পক্ষধর কে ছিলেন?

উত্তরঃ  পক্ষধর মিশ্র ছিলেন মিথিলার অধিবাসী কবি ও নব্য ন্যায়শাস্ত্রে অসামান্য ব্যুৎপত্তির অধিকারী পণ্ডিত ব্যক্তি।


19. 'পক্ষশাতন' কথাটির অর্থ কী?

উত্তরঃ  পক্ষশাতন' শব্দটির অর্থ ডানা ছেঁটে ফেলা। এক্ষেত্রে বাঙালি কিশোর রঘুনাথের কাছে যুক্তি জালে স্বনামধন্য তার্কিক পক্ষধর মিশ্রের পর্যুদস্ত হওয়াকে ফুটিয়ে তুলেছেন।


20.  জয়দেব কে ছিলেন?

উত্তরঃ   জয়দেব হলেন লক্ষণ সেনের সভাকবি। তিনি সংস্কৃত ভাষায় 'গীতগোবিন্দ' রচনা করেন।


21. 'বরভূধরের ভিত্তি'-বলার কারণ কী?

উত্তরঃ  বরভূধর' বা 'বরোবুদুর' দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বর্তমানে। ইন্দোনেশিয়ার খ্রিস্টীয় অষ্টম-নবম খ্রিস্টাব্দে শৈলেন্দ্র রাজবংশের আমলে বৌদ্ধ স্তূপটি নির্মিত হয়।


22. কম্বোজ কোথায় অবস্থিত?

উত্তরঃ  বর্তমান কাম্বোডিয়ার প্রাচীন নাম কম্বোজ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোচিনে এই দেশটি অবস্থিত।


23.  'ওঙ্কারধাম' কী?

উত্তরঃ এটি একটি বিষ্ণু মন্দির। এটি দ্বাদশ শতাব্দীতে দ্বিতীয় সূর্যবর্মনের রাজত্বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কম্বোজ বা কম্বোডিয়ার নির্মিত হয়।


24.  'বিপাল' ও 'ধীমান' কারা?

উত্তরঃ  বরেন্দ্রভূমির বাসিন্দা বিখ্যাত ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী বিপাল। ধীমান এর পিতা বলে কথিত।


25.  বাংলার পটশিল্প কোথায় অক্ষয় হয়ে আছে?

উত্তরঃ অজন্তার গুহাগাত্রে কোনো সুপটু পটুয়ার হাতের লীলায়িত তুলিকায় আঁকা ছবি বাংলার পটশিল্পকেই অক্ষয় রূপ দিয়েছে বলে কবির বিশ্বাস।


26. অজন্তায় কার ছবি আঁকা আছে?

উত্তরঃ  অজন্তায় বুদ্ধদেবের জীবন ও বৌদ্ধ জাতকের ছবি আঁকা আছে।


27. 'কীর্তন' কী?

উত্তরঃ রাধা-কৃষ্ণের লীলাবিষয়ক গান 'কীর্তন' নামে পরিচিত। এই কীর্তন হল দু-প্রকারের- লীলাকীর্তন ও নামকীর্তন।


28. মন্বন্তরে কারা মরেনি?

উত্তরঃ বঙ্গদেশের বাঙালিরা মন্বন্তরেও মরেনি। কবি এখানে ঐতিহাসিক ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কথাই বলেছেন।


29. 'মারী নিয়ে ঘর করি'-বলার কারণ কী?

উত্তরঃ প্রদত্ত উদ্ধৃতাংশে কবি মড়ক, মহামারি, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি ভয়াবহ দুর্বিপাক অতিক্রম করে অমিত প্রাণশক্তির দৃষ্টান্তকে তুলে ধরতেই-এরূপ মন্তব্য করেছেন।


30. 'দেবতারে মোরা আত্মীয় জানি,' কবি এমন কথা বলেছেন কেন?

উত্তরঃ প্রশ্নে উদ্ধৃত বক্তব্যটিতে বাঙালি সাধক-সাধিকাদের দেবতাকে পিতা-মাতা-কন্যা-দয়িতা রূপে তাঁদের ঘরের লোক হিসেবে কল্পনা করার কথা বলা হয়েছে।


31.'আকাশে প্রদীপ জ্বালি'- বলার তাৎপর্য কী?

উত্তরঃ  মৃত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে কার্তিক মাসের সন্ধ্যায় বাঁশের আগায় প্রদীপ জ্বেলে শ্রদ্ধা জানানোর হিন্দু রীতিকে নির্দেশ করে কবি আকাশ প্রদীপ জ্বালার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন।


32.  'মানুষের ঠাকুরালি' বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?

উত্তরঃ মানবীয় চরিত্রের মহত্তম গুণগুলির প্রকাশ তাঁকে দেবত্বে উন্নীত করে; একেই কবি 'মানুষের ঠাকুরালি' বলে অভিহিত করেছেন।


33. 'অমিয় মথিয়া' কথাটির অর্থ কী?

উত্তরঃ পুরাণে বর্ণিত দেবাসুরের সমুদ্রমন্থনের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে কবি 'অমিয় মথিয়া' শব্দবন্ধের মাধ্যমে অমৃত মন্থনের কথাই বলেছেন।


34. নিমাই কার নাম?

উত্তরঃ  নবদ্বীপের জগন্নাথ মিশ্র ও শচীদেবীর কনিষ্ঠ সন্তানের নাম ছিল নিমাই। তিনি পরবর্তীকালে সন্ন্যাস গ্রহণ করে চৈতন্যদেব হয়েছিলেন।


35.  'নিমাই ধরেছে কায়া'- কীসের কায়া ধরেছেন?

উত্তরঃ  বাঙালির হৃদয়-অমৃত মন্থন করে শ্রীচৈতন্যদেব বা নিমাই মানবীয় মূর্তি ধারণ করেছেন।


36. 'ছুটেছে জগৎময়'-বলা হয়েছে কেন?

উত্তরঃ  স্বামী বিবেকানন্দের মানবসেবার আদর্শ সমস্ত বিশ্ববাসীকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এ কথা বোঝাতে গিয়েই কবি 'বীর সন্ন্যাসী বিবেকের বাণী ছুটেছে জগৎময়' পঙ্ক্তিটি লিখেছেন।


37. 'জড়ের সাড়া' বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?

উত্তরঃ  আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু সমগ্র বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছিলেন যে গাছ উত্তেজনায় সাড়া দেয় এবং গাছেরও অনুভূতি আছে। এখানে কবি 'জড়ের সাড়া' বলতে একথাই বলতে চেয়েছেন।


38.  'আমাদের এই নবীন সাধনা শব-সাধনার বাড়া'-কোন্ সাধনাকে নবীন সাধনা বলা হয়েছে?

উত্তরঃ  জগদীশচন্দ্র বসুর আশ্চর্য আবিষ্কার গাছের প্রাণ আছে এবং গাছ উত্তেজনায় সাড়া দেয় বিশ্ববাসীর কাছে এক নতুন দিগদর্শন। একেই কবি নবীন সাধনা বলেছেন।


39.  'শব-সাধনা' বলতে কী বোঝ?

উত্তরঃ তন্ত্র-মতে সদ্য মৃত শবদেহ নিয়ে যে সাধনা তাকেই শবসাধনা বলা হয়ে থাকে।


40.  'ধাতার আশীর্বাদে-কী ঘটবে বলে কবির বিশ্বাস?

উত্তরঃ 'ধাতার আশীর্বাদে' বিধাতার আরদ্ধ কাজ বাঙালি সম্পন্ন করতে পারবে বলে কবির বিশ্বাস।


41.  বেতাল কে?

উত্তরঃ বেতাল পঞ্চবিংশতির কেন্দ্রীয় চরিত্র বেতাল শব-সাধনার মন্ত্র বলে ভূতে পরিণত হয়ে রাজা বিক্রমাদিত্যকে প্রত্যহ । একটি করে গল্প শুনিয়ে তা থেকে একটি করে প্রশ্ন করতেন তাঁর বুদ্ধির পরীক্ষা নেবার জন্য।


42. কার মুখের প্রশ্ন বাঙালি কেড়ে নিয়েছে?

উত্তরঃ  বেতালের মুখের প্রশ্ন বাঙালি কেড়ে নিয়েছে।


43. 'সাধনা ফলেছে' বলে কবি মনে করেছেন। কেন?

উত্তরঃ কবি বিশ্বের দরবারে বাঙালিকে স্বীকৃত হতে দেখে, বাঙালির সাধনা ফলেছে বলে মনে করেছেন।


44. শ্মশানের বুকে কী রোপণ করার কথা কবি বলেছেন?

উত্তরঃ শ্মশানের বুকে অশ্বত্থ, অশোক, আমলকী, বট ও বেল-এই পঞ্চবটী রোপণ করার কথা 'আমরা' কবিতায় কবি ই বলেছেন।


45.  'পঞ্চবটী' কী?

উত্তরঃ  অশ্বত্থ, অশোক, আমলকী, বট ও বেল-এই পঞ্চবৃক্ষের একত্র সমাহার ঘটলে তাকে পঞ্চবটী বলা হয়।


46.  পঞ্চবটীর তলায় বসে কে সাধনা গ করেছিলেন?

উত্তরঃ পঞ্চবটীর তলায় বসে শ্রীরামকৃত্ব পরমহংসদেব সাধনা। করেছিলেন।


47.  'তাহারি ছায়ায় আমরা মিলাব'-বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?

উত্তরঃ মুক্তবেণীর পুণ্যভূমিতে-পঞ্চবটীর ছায়ায় বাঙালির এর সাধনা ও তপস্যায় সমগ্র বিশ্ববাসীর মহামিলন সম্ভব হবে, প্রদত্ত উদ্ধৃতাংশে কবি আশা প্রকাশ করেছেন।



❐ কমবেশি ৬০ শব্দের মধ্যে উত্তর দাও :


1. 'মুক্তবেণী' বলতে কবি কার কথা বুঝিয়েছেন? 'মুক্তবেণী' বলবার কারণ কী? সে কী বিতরণ করছে? ১+১+১ = ৩

উত্তরঃ  'আমরা' কবিতায় সতেন্দ্রনাথ দত্ত 'মুক্তবেণী' বলতে পুণ্য সলিলা গঙ্গাকে বুঝিয়েছেন। 'মুক্তবেণী' শব্দটির আভিধানিক অর্থ বিনুনিমুক্ত এলো চুল। পুরাণ মতে, শিব সুরধুনীর প্রবল তরঙ্গবিক্ষোভকে জটায় ধারণ করেছিলেন, এরপর তা মর্ত্যে গঙ্গা নাম নিয়ে তার উপনদী শাখানদী সহ বিস্তৃত রূপে বঙ্গভূমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। কবি এই প্রসঙ্গটিকে 'মুক্তবেণী' শব্দের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। গঙ্গার বিশুদ্ধ ও পবিত্র জলরাশি বঙ্গদেশে মুক্তি বিতরণ করছে।


2.  'বাস করি সেই তীর্থে-বরদ বঙ্গে’– কবির এমন মন্তব্য করার কারণ কী?

উত্তরঃ  'আমরা' কবিতায় কবি বঙ্গদেশকে স্নেহময়ী জননী হিসেবে কল্পনা করেছেন। তাঁর শস্য-শ্যামল কোল জুড়ে কনক ধান্যের অফুরান ভাণ্ডার। আর সুজলা-সুফলা বঙ্গভূমির মাতৃহৃদয় সন্তানের প্রতি ভালোবাসায় সর্বদাই কোমল ও আর্দ্র। এখানে রয়েছে মহামানবের স্পর্শধন্য অজস্র তীর্থক্ষেত্র। তাদের আশীর্বাদপুষ্ট এই দেশে বাস করলে শত তীর্থের পুণ্য ও আশীর্বাদ লাভ করা যায়। বাঙালি জাতির পরম এই সৌভাগ্যের কথা বলতে গিয়েই কবি এমন মন্তব্য করেছেন।


3. ভালে কাঞ্চন-শৃঙ্গ-মুকুট, কিরণে ভুবন আলা'-পঙ্ক্তিটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো। ৩

উত্তরঃ  'আমরা' কবিতায় কবি সতেন্দ্রনাথ দত্ত উদ্ধৃত উক্তিটির সাহায্যে বঙ্গভূমির অপরূপ সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন। এই বাংলা মায়ের উত্তরে তুষারাবৃত হিমালয় আর সেই তুষার অর্থাৎ বরফের ওপর সূর্যের সোনালি কিরণ পড়ে তা গলিত সোনার মতো আভা বিকিরণ করে। এটিকেই কবি রূপকের মোড়কে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। তাঁর কথায় উত্তরের এই অপরূপ সৌন্দর্য যেন বাংলা মায়ের কপালে সোনার মুকুট সদৃশ, যার প্রভায় সারা পৃথিবী যেন আলোকিত।


4. 'সাগর যাহার বন্দনা রচে শত তরঙ্গ ভঙ্গে'-কবি এমন কথা বলেছেন কেন? ৩

উত্তরঃ  উদ্ধৃতাংশে কবি বঙ্গদেশের দক্ষিণ প্রান্তে স্থিত বঙ্গোপসাগরের ভৌগোলিক অবস্থানটিকে অসামান্য কাব্যিক ব্যঞ্জনায় মূর্ত করে তুলেছেন। কবি-কল্পনায় বঙ্গভূমি এক স্নেহময়ী জননী। আর সাগর তার চরণ স্পর্শ করে আছে। সাগরের বুকে নিরন্তর উঠতে থাকা ঢেউ, প্রতিনিয়ত বঙ্গমাতার চরণ-কমলে আছড়ে পড়ে যেন বারংবার প্রণাম জানিয়ে ফিরে - যায়। তরঙ্গের এই কলধ্বনিই হল মায়ের প্রতি সমুদ্রের অন্তরের। বিনম্র বন্দনা-গান। এখানে কবি এই ছবিই এঁকেছেন।


5.  বঙ্গভূমিকে কবি 'বাঞ্ছিত-ভূমি' বলেছেন কেন?

উত্তরঃ গঙ্গার পবিত্র স্পর্শধন্য বঙ্গদেশ, সমস্ত বাঙালির জন্মভূমি। এই বঙ্গভূমির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কবিকে মুগ্ধ করেছে। - তুষারশুভ্র হিমালয়, সাগরজলে স্নাত বঙ্গভূমির চরণপত্র এবং নানারকম পুষ্পবিন্যাস তার এই সৌন্দর্যকে আরও মোহময়। করে তুলেছে। আবার এই বঙ্গের খেতজোড়া কনকধানা মায়ের বুকের স্নেহের মতোই কবিকে মায়ার বাঁধনে বেঁধে রেখেছে। তাই - সুজলা-সুফলা, বহু তীর্থের পবিত্রতাধন্য মুক্তিদায়িনী বঙ্গভূমিকে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত 'বাঞ্ছিত ভূমি' বলে মনে করেছেন।


6.  'আমরা বাঁচিয়া আছি'-আমরা কারা? তারা কীভাবে বেঁচে আছে? ১+২=৩

উত্তরঃ  এখানে 'আমরা' বলতে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বঙ্গভূমির অধিবাসী বাঙালিদের কথা বলেছেন। বঙ্গভূমিতে বাঙালির বাস। বঙ্গভূমি যেমন সুজলা-সুফলা-উর্বরা, তেমনি এই বঙ্গভূমিতে রয়েছে নদীময় জল-জঙ্গলে পূর্ণ অরণ্যভূমিও। তাই বাঘের সঙ্গে লড়াই করেই আরণ্যক ভূমিতে বসতি তৈরি করেছে বাঙালি। আবার নদী-নালা-বিলে পরিপূর্ণ জলময় ভূ-ভাগে বিভিন্ন বিষাক্ত সাপ তার দৈনন্দিনতার সঙ্গী। বাঙালি অসীম সাহসিকতায় তাকেও হেলায় বশ করে যেন খেলার সামগ্রী করে তুলেছে। এভাবেই বাংলার মানুষ নানান প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে এবং গড়ে তুলেছে এই সভ্যতা।


7. বাঙালির শৌর্যের পরিচয়জ্ঞাপক কোন্ কোন্ ঘটনার উল্লেখ কবি 'আমরা' কবিতায় করেছেন? 

উত্তরঃ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর 'আমরা' কবিতায় শুধু বাংলার কাব্য দর্শন ও মেধার কথা তুলে ধরেননি, তুলে ধরেছেন বাঙালির সাহস ও বীরত্বের দিকটিও। শৌর্যের ও গৌরবের কথা বলতে গিয়ে কবি উত্থাপন করেছেন এই বাঙালিই একদিন রামচন্দ্রের প্রপিতামহ রঘুর সাথে যুদ্ধ করেছিল। তা ছাড়া বিজয় সিংহের লঙ্কা জয় ও সিংহলের নামকরণও বাঙালির শৌর্যের পরিচায়ক। তার উত্তরাধিকারী হয়েই তারা মোগল থেকে মগদের প্রতিহত করেছে। এমনকি বাংলায় চাঁদ-প্রতাপের বীরত্বে একদিন দিল্লীশ্বরকেও পিছু হঠতে হয়েছিল।


8.  'সিংহল নামে রেখে গেছে নিজ শৌর্যের পরিচয়।'-উদ্দিষ্ট ব্যক্তির পরিচয় দাও? উদ্ধৃতাংশটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো। ২+১=৩

উত্তরঃ  প্রাচীন রাঢ়বঙ্গে সিংহপুরের রাজকুমার ছিলেন বিজয়সিংহ। তিনি সমুদ্রপথে লঙ্কাদ্বীপে পৌঁছে সেখানে আপন আধিপত্য বিস্তার করেন। তাঁর নামানুসারে, দেশটির নাম হয়েছিল সিংহল। জাতীয় গৌরবে উদ্বুদ্ধ কবি উদ্ধৃতাংশে এই বিজয়সিংহের কথাই বলেছেন।

এখানে কবি বাঙালির শৌর্য ও অকুতোভয়তার চিরকালীন ঐতিহ্যের উল্লেখ করে বর্তমান বাঙালি প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতে বিজয়সিংহের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন।


9.  'একহাতে মোরা মগেরে রুখেছি, মোগলেরে আর-হাতে'-বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?  অথবা, 'চাঁদ-প্রতাপের হুকুমে হঠিতে হয়েছে দিল্লিনাথে।'-বলার কারণ কী? ৩

উত্তরঃ  উদ্ধৃতাংশের সাহায্যে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত 'আমরা' কবিতায় বাঙালির জাতীয় চরিত্রের অনমনীয়তা, দৃঢ়তা ও পরাক্রমের ঐতিহাসিক বিবরণ দিয়েছেন। অতীতে বাংলায় যখন এ বারবার বিদেশি শক্তি আক্রমণ করেছে বাঙালি তা বীরত্বের সঙ্গে প্রতিহত করেছে, যেমন দুর্ধষ মগজলদস্যুদের প্রতিহত করেছে - আবার একইভাবে বাংলায় বারো-ভূঁইঞায়ারা মোগল শক্তিকে বাংলার মাটিতে মাথাতুলে দাঁড়াতে দেয়নি। কবি স্বজাতির অসম সাহসিকতা এবং মুক্তমনা ব্যক্তিসত্তার স্বরূপ উদঘাটন করতে গিয়ে ⇒ উদ্ধৃত উক্তিটি করেছেন।


10.  এই বাংলার মাটিতে গাঁথিল সূত্রে হীরক-হার-কবি এখানে কার কথা বলেছেন। উদ্ধৃতাংশটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো। ১২২=৩

উত্তরঃ  কবি সতেন্দ্রনাথ দত্ত এখানে বৈদিক ঋষি কপিলের কথা বলেছেন। গঙ্গাসাগরের ঋষি কপিলের একটা আশ্রম আছে। তাই কবি লোকশ্রুতির নিরিখে কপিল মুনির সঙ্গে বাংলা মাটির যোগ আছে বলে মান্যতা দেন। পুরাণ মতে, ঋষি কপিলের ব্যাখ্যাত সাংখ্যদর্শন অনুসারে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই। একমাত্র পুরুষরূপী আত্মা ও প্রকৃতি অনাদি ও অনন্ত। কবি প্রজ্ঞা ও দর্শনের আশ্চর্য স্বতন্ত্রের অধিকারী। ঋষিকেই আদি বিদ্বান অর্থাৎ প্রথম জ্ঞানী বলে মনে করেছেন। তাঁর এই সাংখ্য দর্শনের হীরকসূত্র বা যুক্তিবিন্যাস বাংলার মাটিতেই বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিল বলে কবি গৌরব বোধ করেছেন।


11.  'বাঙালি অতীশ লঙ্ঘিল গিরি তুষারে ভয়ংকর, জ্বালিল জ্ঞানের দীব তিব্বতে বাঙালি দীপঙ্কর'। -উদ্ধৃতাংশটি ব্যাখ্যা করো। ৩

উত্তরঃ  'বাঙালি অতীশ' হলেন নালন্দার অধ্যক্ষ শীলভদ্রের। ছাত্র। এই বৌদ্ধ পণ্ডিত জয়পালের সময়ে বিক্রমশীল মহাবিহারের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। বৌদ্ধ ধর্ম (মহাযান) প্রচারের জন্য তিনি তিব্বতে যান। সেখানে তিনি শিক্ষাদান, বৌদ্ধ সাধন তত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থ রচনা এবং সাধনা শুরু করেন। এককথায় তিব্বতে অজ্ঞতার আঁধার দূর করে জ্ঞানচর্চার পথকে প্রশস্ত করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। তাঁর মনন ও মেধার অবদান বাঙালির কাছে গৌরববাহী।


12. 'বাঙালির ছেলে ফিরে এল দেশে যশের মুকুট পরি-উদ্ধৃতাংশটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।  অথবা, 'কিশোর বয়সে পক্ষধরের পক্ষশাতন করি'-বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন? ৩

উত্তরঃ  উদ্ধৃতাংশে বাঙালি কিশোর হলেন তার্কিক রঘুনাথ শিরোমণি আর 'পক্ষধর' হলেন মিথিলার ন্যায় দর্শনের পন্ডিত। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে ভারতের জ্ঞানচর্চায় অন্যতম পীঠস্থান হয়ে উঠেছিল নবদ্বীপ। শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক রঘুনাথ শিরোমণি বিখ্যাত নৈয়ায়িক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। তিনি তর্ক যুদ্ধে পক্ষধর মিশ্রকে পরাজিত করেছিলেন। এই পরাজয়ের মাধ্যমেই বাঙালির ঐতিহাসিক উত্থানের আরম্ভ। এই ঘটনাটিকে জাতীয় গৌরববাহী বলে মনে করেই কবি প্রশ্নে উদ্ধৃত মন্তব্যটি করেছেন।


13.  'বাংলার রবি জয়দেব কবি কান্ত কোমল পদে/করেছে সুরভি সংস্কৃতের কাঞ্চন-কোকনদে।-উদ্ধৃতাংশটি ব্যাখ্যা করো। ৩

উত্তরঃ  কবি জয়দেব লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি বলে কথিত। তাঁর লেখা রাধাকৃয় লীলা বিষয়ক পদাবলিটির নাম 'গীতগোবিন্দ'। স্বয়ং শ্রীচৈতন্য এই পদাবলিটির গুণমুগ্ধ ছিলেন। গীতগোবিন্দের সুললিত ভাষা ও ভাবের জন্য তা সমগ্র ভারতে আজও জনপ্রিয়। কবি সত্যেন্দ্রনাথের মতে, তাঁর কবিপ্রতিভা সংস্কৃত সাহিত্যকেও প্রভাবিত করেছিল। কবির মতে, তৎকালীন সময়ের জনপ্রিয়তার নিরিখে জয়দেব ছিলেন বর্তমান যুগের রবিঠাকুরের মতো বিখ্যাত।


14.  'বরভূধরের ভিত্তি এবং ওষ্কার-ধাম'-এর প্রসঙ্গ বাঙালির জাতীয় গৌরব আলোচনাকালে কবি উল্লেখ করেছেন কেন বলে তোমার মনে হয়? 

উত্তরঃ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জাভা বা ইন্দোনেশিয়ায় অবস্থিত প্রাচীন বৌদ্ধ স্তূপ হল 'বরভূধর' বা 'বরোবুদুর'। অষ্টম-নবম শতকে শৈলেন্দ্র রাজবংশের রাজত্বকালে এই স্থাপত্য কীর্তিটি গড়ে উঠেছিল যাতে পাল ও সেন যুগের স্থাপত্য পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে 'ওঙ্কার-ধাম' মন্দিরটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কম্বোজ বা কম্বোডিয়ায় অবস্থিত। দ্বাদশ শতাব্দীতে খামের রাজা দ্বিতীয় সূর্যবর্মনের রাজত্বকালে তৈরি এই বিষ্ণু মন্দিরটি। পরে অবশ্য এটি বৌদ্ধ মন্দিরে পরিণত হয়েছিল। এই মন্দিরে পালযুগের স্থাপত্য পরিলক্ষিত হয়। 'আমরা' কবিতায় কবি বাংলায় স্থাপত্য ও শিল্প ভাবনার উৎকর্ষ প্রসঙ্গে উক্তিটি করেছেন।


15.  'ধেয়ানের ধনে মূর্তি দিয়েছে আমাদের ভাস্কর'-এখানে 'আমাদের ভাস্কর' কারা? 'ধেয়ানের ধনে' শব্দবন্ধের মাধ্যমে কবির কোন্ মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে? ১+২=৩

উত্তরঃ  'আমরা' কবিতায় কবি সত্যেন্দ্রনাথ 'আমাদের ভাস্কর' বলতে পালযুগের বিখ্যাত ভাস্কর ও স্থপতি, বরেন্দ্রভূমির বাসিন্দা বিটপাল আর ধীমানের কথা বলা হয়ছে।

ভাস্কর তার আপন কল্পনায় মাধুরী মিশিয়ে ছেনি-হাতুড়ির সাহায্যে কঠিন পাথর বা ধাতুর ওপর মূর্তি বা ছবিকে ফুটিয়ে তোলেন। এক আশ্চর্য দক্ষতা ও প্রতিভা বলে শিল্পী তাঁর আবেগ, দর্শন চিন্তায় সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম দিক ভাস্কর্যের গায়ে মুদ্রিত করেন। এক্ষেত্রে ধেয়ানের ধন, বলতে কবি ধ্যানের একাগ্রতা ও সাধনার কথা বলেছেন, 'ধীমান' ও 'বিটপাল' তাঁদের ভাস্কর্যে তাঁদের স্বাতন্ত্র্যকে এই একাগ্রতার সাহায্যে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।


16. 'আমাদের পট অক্ষয় করে রেখেছে অজন্তায়'-'অজন্তা' কী? আমাদের পট সেখানে কীভাবে অক্ষয় হয়ে আছে? ১+২=৩

উত্তরঃ  অজন্তা হল মহারাষ্ট্রের 'ঔরঙ্গাবাদ থেকে প্রায় ১০০ কিমি দূরে অবস্থিত পাহাড়ের গা কেটে তৈরি গুহা। এখানে যুদ্ধের জীবন ও জাতকের কাহিনি নিয়ে ছবি আঁকা হয়েছে। কবি বাঙালির জাতীয় গৌরবের দৃষ্টান্তে অজন্তার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন, কারণ এখানে হাতি ও অশ্বারোহী পরিবৃত বিজয় সিংহের একটি ছবি এবং সিংহলরাজ হিসেবে তাঁর অভিষেকের আর-একটি ছবি আছে। কবির মতে, বাঙালি রাজপুত্রের বীরগাথা যে-কোনো বাঙালি পটুয়ার তুলির আঁচড়ে অজন্তার গুহাচিত্রে চিরকালীন মর্যাদা লাভ করেছে।


17.  'কীর্তনে আর বাউলের গানে আমরা দিয়েছি খুলি'- বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?

উত্তরঃ  'কীর্তন' আর 'বাউল' বাংলা অতিপ্রাচীন দুই সংগীত। ধর্মীয় বিভাজন ও সংকীণতার ওপরে উঠে ভালোবাসা আর আত্মানুসন্ধানের গান গায় বাউল, আর অন্যদিকে রাধাকৃষ্ণের লীলাকে অবলম্বন করে মানব-মানবীর প্রেমানুভূতির আকুলতা প্রাণ পায় কীর্তনে। বাঙালি তার হৃদয়ের সুখ-দুঃখ ভালোবাসা ও মিলনের আনন্দ-বেদনাকে বাণীরূপ দিয়েছে বাউলে কীর্তনে। সে তার মনের দরজা খুলে সকলের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে এই গানের প্রাণময়তায়। এই গানই বাঙালির আপন-পর ভুলে সবাইকে বক্ষমাঝে ধারণ করার ঐতিহ্যের ঐশ্বর্য। উদ্ধৃতাংশে কবির সেই ভাবনাই প্রকাশিত হয়েছে।


18.  'মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি'-কবি এখানে কোন্ ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন? ৩

উত্তরঃ  কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত 'আমরা' কবিতায় বাংলার অতীত ইতিহাসের যন্ত্রণাক্লিষ্ট ও বেদনাদায়ক দিনগুলির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বাংলার ভাগ্যাকাশে মন্বন্তর, মহামারি, মড়ক, দুর্যোগ বারবার হানা দিয়েছে। মন্বন্তর বা দুর্ভিক্ষে শত-সহস্র মানুষ মারা গেছে। দুরারোগ্য মহামারির কবলে পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কত-শত গ্রাম, সমৃদ্ধ জনপদ। কিন্তু মৃত্যু-অপচয় বঙ্গভূমিকে সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করলেও, বাঙালি ফের তার অস্তিত্বের বিপন্নতা কাটিয়ে অফুরান জীবনীশক্তির পরিচয় দিয়েছে। মন্বন্তর মহামারির সংকট কাটিয়ে গড়ে তুলেছে নিজের সভ্যতা, প্রশ্নে উদ্ধৃত অংশে এই ঘটনার কথাই কবি বলেছেন।


19.  'দেবতারে মোরা আত্মীয় জানি- উদ্ধৃতাংশে বাঙালির চরিত্রের কোন্ দিকটি ফুটে উঠেছে?

উত্তরঃ  উদ্ধৃতাংশটির ব্যাখ্যা কালে রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার লাইন বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। প্রিয়জনের মধ্যে দৈব মহত্ত্ব প্রকাশিত হতে দেখে তিনি লিখেছেন 'দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা...'। বাঙালির সত্তায় মিলনের সুর চিরপ্রবাহমান, মানুষকে ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে সে স্বর্গের দেবতাকেও নামিয়ে এনেছে নিজের ঘরের আঙিনায়। তাই দেবদেবীরা যেন ঘরে ছেলে মেয়ে বা মায়ের মতো, আবার এই আটপৌরে বাঙালি বাড়িতেই জন্ম নেওয়া সর্বগুণান্বিত অসামান্য মানুষকে বিশ্ববাসী দেখতে পেয়েছে দেবত্বসুলভ মহিমার।


20.  'ঘরের ছেলের চক্ষে দেখেছি বিশ্বভূপের ছায়া'-এখানে 'ঘরের ছেলে' বলতে কার কথা বলা হয়েছে? তাঁর চোখে 'বিশ্বভূপের ছায়া' কেমনভাবে দেখতে পাওয়া যায়? ৩

উত্তরঃ  প্রদত্ত উদ্ধৃতাংশে 'ঘরের ছেলে' বলতে কবি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কথা বলেছেন। 'বিশ্বভূপের ছায়া' শব্দবন্ধের মাধ্যমে কবি এ জগতের হৃদয়-রাজ্যের অধীশ্বরের অন্তরের স্নেহছায়ার করুণাঘন রূপটিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। শ্রীচৈতন্য ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল-শূদ্র নির্বিশেষে সবাইকে হৃদয়ের অফুরান প্রেম-ভালোবাসা বিতরণ করেছেন। শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ তিনি মানতেন না। বিশ্ববাসীকে তিনি মানবধর্মের সর্বজনীন আদর্শে দীক্ষিত করেছিলেন। মানব-হৃদয়ের এই সর্বোত্তম গুণ ঘরের ছেলে নিমাইয়ের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছিল বলেই বাঙালি তার চোখে 'বিশ্বভূপের ছায়া' দেখতে পেয়েছিল।


21.  'নিমাই ধরেছে কায়া'-নিমাই কায়া ধরেছে কীভাবে?

উত্তরঃ উদ্ধৃতাংশটি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের 'আমরা' কবিতার অংশবিশেষ। উদ্ধৃতিটির মধ্যে দিয়ে বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্র শ্রীচৈতন্যের ব্যক্তিত্বের স্বরূপ উদ্‌ঘাটিত হয়েছে। কবি 'অমিয়-মথিয়া' শব্দ বন্ধের মাধ্যমে বাঙালির হৃদয়জাত স্নেহ-মায়া-মমতা-দয়া-ভক্তি ও ভালোবাসার মতো মহত্তম মানবিক গুণাবলি শ্রীচৈতন্যের মধ্যে প্রকাশিত হবার কথা বলেছেন। সমস্ত বিভেদ ভুলে মানুষকে ভালোবাসাতে শিখিয়ে ছিলেন নিমাই। বাঙালির হৃদয়ের সর্বত্যাগী প্রেমিক সত্তাই সেই ভালোবাসার বিগ্রহ নিমাই-এর মধ্যে বাণীরূপ পেয়েছে-কবি এ-কথাই বলেছেন।


22.  'বীর সন্ন্যাসী বিবেকের বাণী ছুটেছে জগৎময়'- 'বীর সন্ন্যাসী বিবেকের' পরিচয় দাও? তাঁর বাণী জগৎময় ছুটেছিল কেন? ১+২=৩

উত্তরঃ এখানে 'বীর সন্ন্যাসী বিবেক' হলেন স্বামী বিবেকানন্দ। স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো ধর্ম সম্মেলনে ভারতের সনাতন হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে আধ্যাত্মিকতা ও দর্শন বিষয়ক যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, তা শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে। সারা ইউরোপ আমেরিকা জুড়ে তাঁর আদর্শ, বাণী ও মানবসেবার দর্শন এক ভাবতরঙ্গের সৃষ্টি করেছিল। পৃথিবীর নানান প্রান্তের মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছে, যোগ দিয়েছে মানবসেবায়। কবি বিবেকানন্দের আকর্ষণ ক্ষমতাকে ফুটিয়ে তুলতেই উক্তিটি করেছেন।


23.  'বাঙালির ছেলে ব্যাঘ্ৰে বৃষভে ঘটাবে সমন্বয়'-উক্তিটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো। ৩

উত্তরঃ প্রদত্ত উদ্ধৃতাংশে কবি এক ঐতিহাসিক সত্যকে  বাণীরূপ দিয়েছেন। ব্যাঘ্র ও বৃষভের সমন্বয় কথাটির অর্থ বাঘ যু ও ষাঁড়ের মধ্যে একাত্মতা ঘটানো। বাস্তবে তা সম্ভব নয়। কিন্তু মা এক মহামানবের বাণী ও ব্যক্তিত্বের জাদুস্পর্শে যেন এই ঘটনাই কি বাস্তবায়িত হয়েছিল। শ্বেতাঙ্গরা এদেশীয়দের ঘৃণা করতেন। না আবার এদেশীয়দের মনেও শ্বেতাঙ্গদের প্রতি বিদ্বেষ ও ভয় সে পুঞ্জীভূত ছিল। তবে ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে শিকাগো ধর্মসম্মেলনে বিবেকানন্দের মানবসেবার আদর্শ ঘোষিত এবং প্রচারিত হওয়ার গ পর, তা সমস্ত মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। শ্বেতাঙ্গরাও সব ত্যাগ করে এদেশে এসে মানবসেবার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কে এভাবেই বাঙালির ছেলে উভয়ের মধ্যে সমন্বয়ের বীজ বপন করতে পেরেছিল বলে কবি মনে করেছেন।


24.  'তপের প্রভাবে বাঙালি সাধক জড়ের কাল পেয়েছে সাড়া'-'বাঙালি সাধক' কে? জড়ের সাড়া পাওয়া মধে বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন? ১+২ = ৩

উত্তরঃ কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রচিত 'আমরা' কবিতা থেকে উদ্ধৃত এই পঙ্ক্তিটিতে 'বাঙালি সাধক' বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর কথা বলা হয়েছে। 'জড়ের সাড়া' পাওয়া কথাটির অর্থ 'তথাকথিত' জড়বস্তুর উত্তেজনায় সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা। দীর্ঘদিনের ধারণা ছিল মানুষ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ বাদে গাছপালার কোনো অনুভূতি নেই। কিন্তু জগদীশচন্দ্র বসু প্রথম প্রমাণ করেছিলেন যে, উদ্ভিদ অর্থাৎ গাছেদেরও অনুভূতি আছে, এমনকি তারাও উত্তেজনায় সাড়া দেয়। জড়ের সাড়া পাওয়া বলতে কবি এই কথাই বলতে চেয়েছেন।


25. 'তাহারই ছায়ায় আমরা মিলাব জগতের শতকোটি'-বলার কারণ কী?

উত্তরঃ উদ্ধৃতাংশে কবি শ্মশানের বুকে পঞ্চবটী রোপণ করে, তার ছায়ায় জগৎবাসীর মিলনের স্বপ্ন দেখেছেন। 'পঞ্চবটী' হল অশ্বত্থ, আমলকী, অশোক, বেল ও বটের সমাহার। তবে বাঙালির কাছে 'পঞ্চবটী' রামকৃষ্ণের সাধনক্ষেত্র হিসেবেই বিশেষ তাৎপর্যবাহী। অন্যদিকে 'শ্মশান' হল জীবনের অবসানের প্রতীক। তা শূন্যতা ও রিক্ততার সূচক। সেখানে পঞ্চবটী রোপণের অর্থ, একদিকে যেমন বিভিন্নতার একত্রীকরণ, অন্যদিকে তেমনি নিঃস্ব প্রান্তরের বুকে প্রাণশক্তির আবাহন। অর্থাৎ বাঙালি তাঁর হৃদয়ের অনুপ্রেরণায় শূন্য শ্মশানকেও পঞ্চবটীর নব নব প্রাণে পূর্ণ করে তুলবে। নবজীবনের স্বপ্নে ও মহামিলনের গানে বাঙালির ভালোবাসার শক্তিতে বিশ্ববাসী এখানে মিলিত হবে। এই আশাবাদে পূর্ণ কবির অঙ্গীকার।


26.  'প্রতিভায় তপে সে ঘটনা হবে, লাগিবে না তার বেশি'-এখানে কবির কোন্ মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছে? অথবা, 'ভরিবে ভুবন বাঙালির গৌরবে'-এমন বলার কারণ কী বলে তোমার মনে হয়?

উত্তরঃ  সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের 'আমরা' কবিতায় বাঙালির গৌরব- গাথার দৃষ্টান্তগুলি সর্বদাই উজ্জ্বল। অতীতে যেসব কাজ শুরু হয়েছিল তাকে সম্পন্ন করতে হবে। আর বাঙালি তা পারবে। বাঙালি তার অন্তরের প্রেম ভালোবাসা দিয়ে সমস্ত বিশ্ববাসীকে একত্রিত করে সকলের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণসাধনের মধ্যে দিয়েই তা প্রতিষ্ঠা করবে। এক্ষেত্রে বিদ্বেষ বা হিংসা নয়, প্রতিভা ও সাধনার - সমন্বয়েই জগতে বাঙালি শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করবে এবং সেদিন সর্ব মানবের মঙ্গলঘট পূর্ণ হবে।


27.  'লাগিবে না তাহে বাহুবল কিবা জাগিবে না দ্বেষাদ্বেষি;'-পঙ্ক্তিটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।

উত্তরঃ 'আমরা' কবিতায় বাঙালির জাতীয় চেতনার অন্তর্গত স্বরূপ মূর্ত হয়ে উঠেছে। বাঙালির স্বাজাত্যবোধ এবং স্বজাতিপ্রীতির মধ্যে উগ্রতার কোনো স্থান নেই। সেখানে নেই অন্যের প্রতি কোনো বিদ্বেষ বা ঘৃণা। অপরকে হীন বা ছোটো প্রমাণ করে বাঙালি আত্মপ্রতিষ্ঠা চায় না। সে মিলনের মহামন্ত্রে সকলের অন্তরাত্মা জাগ্রত করতে চায়। তাই বিদ্বেষ-বাহুবল বা এ ঈর্যাকে বাঙালি কখনই পাথেয় করেনি, প্রেম-ভালোবাসা ও ই মানবিকতার স্নেহডোরে সে সকলের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে। ক উদ্ধৃতাংশে এ কথাই ব্যস্ত হয়েছে।


❐ কমবেশি ১৫০ শব্দের মধ্যে উত্তর দাও:


1. কবি সত্যেন্দ্রনাথের 'আমরা' কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার করো। ৫

উত্তরঃ সাহিত্যক্ষেত্রে নামকরণ একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নামকরণের সাহায্যে সাহিত্যিক তাঁর সাহিত্য কর্মকে পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। একইভাবে পাঠকও সেই সাহিত্য কর্মের রসাস্বাদনের অভিমুখ খুঁজে পায়। 'গল্প' নাটক ইত্যাদির ক্ষেত্রে ঘটনা, চরিত্র ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে নামকরণ হয় কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে তা হয় না। এক্ষেত্রে বিষয়বস্তু কিংবা ভাব অনুযায়ী নামকরণ হয়ে থাকে। অনেক সময় আবার ব্যঞ্জনাধর্মী নামকরণও হয়ে থাকে।

আমাদের পাঠ্য সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের 'আমরা' কবিতাটির নামকরণ কতটা সার্থক হয়েছে তা বিচার্য। কবি এই কবিতাটিতে বাংলার প্রকৃতির রূপসৌন্দর্য যেমন তুলে ধরেছেন, তার সঙ্গে বাঙালির শৌর্য-বীর্য, জ্ঞান-গরিমা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, লড়াকু মানসিকতাও তুলে ধরেছেন। তিনি বাঙালির কৃষ্টি, সংস্কৃতির সঙ্গে তার বিশ্বমানবতা বোধকেও এই কবিতায় তুলে ধরেছেন। বাঙালির দেবতাকে প্রিয় আর প্রিয়েরে দেবতা করার ক্ষমতার কথাও এখানে তুলে ধরেছেন কবি। তাঁর কথায়, বাঙালির হাত ধরে মানুষ একদিন মিলনের মহামন্ত্রে দীক্ষিত হবে। এক কথায় ৪ 'আমরা' কবিতায় আমরা বাঙালিরা আমাদের নিজেদের যেন ব প্রত্যক্ষ করি। তাই বিষয়বস্তুগত দিক থেকে কবিতাটির নামকরণ অ যথাযথ ও সার্থক বলেই মনে হয়।


2.  'আমরা' কবিতা অবলম্বনে কবির স্বাজাত্যবোধ এবং স্বদেশপ্রীতির পরিচয় দাও।

উত্তরঃ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় সমকালীন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বাংলা জুড়ে বাঙালির হৃদয়ে জাতীয়তা বোধ এবং স্বাদেশিকতার এক আকুল ভাবতরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছিল। আলোচ্য কবিতায় কবি উজ্জীবিত সেই জাতির গৌরবময় সাংস্কৃতিক ইতিহাসের নিরিখে ভবিষ্যতের দিকচিহ্ন অঙ্কন করেছেন। স্নেহময়ী বঙ্গভূমির ভৌগোলিক স্বাতন্ত্র্য, ঐতিহাসিক ঐতিহ্য, ধর্ম-সাহিত্য-জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পচর্চার ব্যাপ্ত সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্যের কাব্যিক স্বরুপ প্রকাশ পেয়েছে। পুণ্যতোয়া গঙ্গার তীরে তীর্থভূমি স্বরূপ বাংলায় আমরা বাস করি। নানান বিরোধী শক্তির সঙ্গে লড়াই করে বাঙালি তার অস্তিত্ব রক্ষা করেছে। বিজয় সিংহ ও চাঁদ প্রতাপ তার জ্বলন্ত উদাহরণ। শুধু সাহসে ও বীরত্বে নয় জ্ঞানের জগতেও বাঙালি বিশ্ববাসীর মন জয় করেছে। ভাস্কর্য ও সংগীতের জগতেও বাঙালির অবদান অবিস্মরণীয়। পাল ও সেন যুগের স্থাপত্য শিল্পকলা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান দেশগুলিকে প্রভাবিত করেছিল। এমনকি অজন্তার চিত্রগুলিতেও বাঙালির প্রভাব পড়েছে। নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে বাঙালি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। চৈতন্য ও বিবেকানন্দের হাত ধরে বাঙালির বিশ্বমানবতার বাণী বিশ্বময় হৃদয় প্লাবিত হয়ে তরঙ্গ সৃষ্টি করেছে। বিজ্ঞানসাধনাতেও বাঙালি পথিকৃৎ। জগতের মৌলিক প্রশ্ন তুলে তার সমাধানও বাঙালিই করেছে। কবির বিশ্বাস বাঙালি তপস্যাবলেই তার গৌরব পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করবে। বাহুবল, বিদ্বেষ বা ঈর্ষাকে দূরে সরিয়ে মিলনের মহামন্ত্রে পুণ্যতোয়া গঙ্গার তীরেই বাঙালির জাগরণ ঘটবে।


3. 'আমরা' কবিতায় কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বঙ্গভূমির যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছেন তার স্বরূপ বিশ্লেষণ করো।

উত্তরঃ কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বঙ্গভূমির রূপসৌন্দর্যকে প্রকাশ করেছেন 'আমরা' কবিতায়। গঙ্গানদী বিধৌত এই বঙ্গভূমি। পুণ্যতোয়া নদীতীরস্থ এই বাংলার মাটিতে রয়েছে অনেক মহামানবের স্পর্শ। গঙ্গার জলধারা বাহিত পলিময় এদেশের মাটিতে সোনার ফসল ফলে। সোনালি ধানে ভরে থাকে গোটা দেশ। তা যেন মায়ের স্নেহের মতো ঝরে পড়ে বাংলার বুকে। নানারকম পুষ্পরাজিতে পরিপূর্ণ বঙ্গমাতার দেহ। অতসী-অপরাজিতা-পদ্মের মতো কতরকম ফুলের সুগবে আমোদিত হয় এদেশের বাতাস। কোথাও কমলালেবুর ফুল, কোথাও বা মহুয়ার মাদকতাপূর্ণ গন্ধে ভরে থাকে বাংলার আকাশ গাঙ্গেয় সমতল ভূমির এ-ছবি বদলে যেতে থাকে উত্তরে। সেখানে কাঞ্চনবর্ণা হিমালয় পর্বতের কাঞ্চন-শৃঙ্গ-মুকুটের আশ্চর্য দীপ্তি হৃদয় রাঙিয়ে দেয়। বরফাচ্ছাদিত পাহাড়ের চূড়াগুলো যেন এই বঙ্গভূমির মাথার সোনার মুকুট। সূর্যের আলোয় তা কাঞ্চনবর্ণ ধারণ করে। পর্বতচূড়ায় প্রতিবিম্বিত আলোয় প্লাবিত হয় চারিদিক। আবার উত্তরবঙ্গের এই ছবি বদলে যায় দক্ষিণবঙ্গো সেখানে বঙ্গোপসাগরের জলধারায় প্রতিমুহূর্তে উদ্বেলিত হয়ে চলেছে উপকূলের মাটি। মনে হয় শততরঙ্গে সাগর যেন বঙ্গভূমির চরণবন্দনা করছে। বঙ্গভূমির এইরূপ দেখতে দেখতে কবিও যেন বলতে চেয়েছেন 'ওগো মা তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ভরে।'


4.  আমরা' কবিতাটির অনুসরণে বাঙালির  শৌর্যের পরিচয় দাও।

উত্তরঃ  স্বাজাত্যবোধে উদ্বুদ্ধ কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত 'আমরা'র কবিতায় বাঙালি জীবনের শৌর্যদীপ্ত অতীতের রূপটি ফুটিয়ে ৪ তুলেছেন। তার অতীত বীরত্বগাথাকে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন কবি। অরণ্যসংকুল দক্ষিণবঙ্গে হিংস্র বাঘের সঙ্গে লড়াই করে বাঙালি সেখানে জনবসতি গড়ে তুলেছে, আবার বিষাক্ত সাপকেও করে তুলেছে খেলার সামগ্রী। একসময় এই বাঙালিই চতুরঙ্গে সজ্জিত হয়ে রামচন্দ্রের প্রপিতামহের সঙ্গে লড়াই করেছে। একদা এই বাংলার দুঃসাহসী রাজকুমার বিজয়সিংহ রাঢ়-বাংলা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন সুদূর লঙ্কায়। সেখানে সমৃদ্ধ এক রাজ্য এবং রাজবংশ গড়ে তুলেছিলেন তিনি। তাঁর হাত ধরেই আর্যসভ্যতা ও সংস্কৃতি সেখানে প্রবেশ করেছিল। সেই থেকেই তাঁর নামানুসারে লঙ্কার নাম হয় সিংহল। কবি মনে করিয়ে দিয়েছেন সেইসব দিনগুলির কথা, যেদিন এই বাঙালি মগ জলদস্যুদের আক্রমণ কোনো রাজশক্তির সাহায্য ছাড়াই শুধু আত্মশক্তিতে নির্ভর করে প্রতিহত করেছিল। একইভাবে তারা প্রতিহত করেছিল মোগলদের আক্রমণও। এই প্রসঙ্গে চাঁদ রায় বা প্রতাপাদিত্যের অসমসাহসী স্বাধীনসত্তার কথা উল্লেখ করেছেন কবি। আর এভাবেই বাঙালির শৌর্য এবং অকুতোভয়তার চিরকালীন ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কবি বর্তমান প্রজন্মকে আপসহীন ও নির্ভীক হতে অনুপ্রাণিত করেছেন।


5.  'আমরা' কবিতায় বাঙালির দর্শনচিন্তা-শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বিশেষত্বের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা আলোচনা করো। ৫

উত্তরঃ  'আমরা' কবিতায় সতেন্দ্রনাথ দত্ত জ্ঞানচর্চা-দর্শন-শিল্প ও সাহিত্যে বাঙালির সুমহান ঐতিহাসিক পাঠোদ্ধার করে সেই অবিস্মরণীয় গৌরবগাথাকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। কবি তাঁর জন্মভূমি বাংলার আদি বিদ্বান হিসেবে ঋষি কপিলের নাম স্মরণ করেছেন, প্রাজ্ঞ নিরীশ্বরবাদী কপিল সাংখ্য দর্শনের বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করে বাংলার বাইরে ও বাঙালির মেধা ও প্রজ্ঞাকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এরপর কবি বাঙালি অতীশ অর্থাৎ অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের কথা তুলেছেন, যিনি বরফাবৃত দুর্গম পথ অতিক্রম করে সুদূর তিব্বতে অজ্ঞতার আঁধার দূর করে জ্ঞানচর্চার পথকে প্রশস্ত করেছিলেন। বঙ্গদেশের আর এক পতিত নৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণি যিনি মিথিলার তার্কিক পণ্ডিত পক্ষধরকে পরাস্ত করে বাংলার গৌরব বৃদ্ধি করেছিলেন এবং নবদ্বীপে ন্যায়চর্চার প্রসার ঘটাতে সাহায্য করেছিলেন। আবার লক্ষণ সেনের সভাকবি জয়দেব কান্ত কোমল পদ লিখে শুধুমাত্র বাঙালির নয়, বিশ্ববাসীর মন জয় করে নিয়েছিলেন। বাঙালি স্থাপত্য শিল্পী বিটপাল ও ধীমান তাদের ভাস্কর্য পরিকল্পনার সাহায্যে বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করেছেন। কীর্তন ও বাউলের গানে কবি বাঙালি হৃদয়ের স্পর্শ পেয়েছেন। আত্মপর ভুলে সকলকে বক্ষমাঝে ধারণ করার ঐতিহ্য সার্থকভাবে প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কবিতায়। তাই বাঙালি বিশ্বের দরবারে তার সাধনায় প্রাপ্য মর্যাদা আজও লাভ করে চলেছে।


6. সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের 'আমরা' কবিতাটির অনুসরণে বাঙালির অতীত গৌরবগাথা আলোচনা করো।  অথবা, 'আমরা' কবিতা অবলম্বনে কবির জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করো। ৫

উত্তরঃ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং স্নেহচ্ছায়ায় আপ্লুত হয়ে এই দেশকে বাঞ্ছিত ভূমি বলে মনে করেছেন এবং বাঙালির সুমহান ঐতিহ্যগুলিকে বর্তমান পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন। অরণ্যসংকুল সুন্দরবনে বাঘের সঙ্গে লড়াই করে কিংবা বিষাক্ত সাপকে পোষ মানিয়ে বাঙালি সভ্যতা ও জনবসতি গড়ে তুলেছে। শুধু তাই নয়, বিজয়সিংহের লঙ্কাজয়, চাঁদ রায়, প্রতাপাদিত্যদের মোগলদের প্রতিহত করা-সবই দৃঢ়চেতা বাঙালির পরিচয়জ্ঞাপক। বাঙালির এই বীরত্ব ও সাহসিকতার কাহিনি আজও গৌরবগাথা হিসেবে উচ্চারিত হয়।

শুধু শৌর্যে বা বীরত্বে নয়, জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, মেধায়, সাহিত্য ও ভাস্কর্যে বাঙালি তার কৃতিত্বকে কিন্তু ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্ব মাঝে। দার্শনিক পণ্ডিত কপিল, রঘুনাথ তার্কিক, অতীশ দীপঙ্কর জ্ঞানে-পান্ডিত্যে বাঙালির বিজয়কেতন উড়িয়েছেন। কবি জয়দেবের সুললিত ছন্দে ভারতবাসী মুগ্ধ। বিটপাল ও ধীমানের ভাস্কর্য, চৈতন্য এবং বিবেকানন্দের ভক্তিরস ও মানবসেবার মন্ত্র বিশ্ববাসীকে আকৃষ্ট করেছে। বাঙালির বিজ্ঞানসাধনা বৈজ্ঞানিক জগতেও তার মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করেছে। বাঙালির এই অতীত তার নতুন করে বাঁচার চাবিকাঠি। রবীন্দ্রনাথের মহামিলনের গান আসলে বাঙালি বীজমন্ত্র। কবির প্রত্যাশা বাঙালি তার সাধনা ও প্রতিভাবলে সকলের মঙ্গলঘট পূর্ণ করার মধ্যে দিয়েই তার শ্রেষ্ঠত্বের সূচনা করবে।


7.  'বাঙালির হিয়া অমিয় মথিয়া নিমাই ধরেছে কায়া'- এই পঙক্তিটির আলোকে বাঙালির ঈশ্বর-ভাবনা ও মানবপ্রীতির পরিচয় দাও। ৫

উত্তরঃ 'আমরা' কবিতায় বাঙালির মর্মে নিহিত অধ্যাত্মভাবনার মূল সুরটিকে কবি সত্যেন্দ্রনাথ ফুটিয়ে তুলেছেন। বাঙালির = অনুভবে ভক্তের সঙ্গে ভগবানের কোনো ব্যবধান থাকে না। - তাঁর ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস আসলে নিজের ওপর বিশ্বাসেরই নামান্তর। তাই ক্ষুধার জ্বালা কিংবা মহামারি নিয়ে ঘর করলেও বাঙালি ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখেছে। ঈশ্বরের প্রতি সর্বস্ব সমর্পণের এই বোধ, দেবতা ও মানুষের ভেদাভেদহীন পরম আত্মীয়তার কারণেই গড়ে ওঠে। এই বাংলার আটপৌরে ঘরেই, বাঙালির হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা মন্থন করে দেহরূপ ধারণ করেছিলেন নিমাই। বাঙালির দয়া-মায়া-প্রেম ও তিতিক্ষার সামগ্রিক প্রকাশ ঘটেছে সর্বগুণান্বিত নিমাইয়ের চরিত্রে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি সবাইকে বক্ষমাঝে ঠাঁই দিয়েছিলেন। এভাবেই শ্রীচৈতন্যের হৃদয়ের স্নেহ-ছায়ার করুণাঘন রূপ তাঁকে বাঙালির হৃদয়-রাজ্যের অধীশ্বরে পরিণত করেছে। পতিত, পীড়িত, উচ্চ, নীচ-এই সকলের দৈনন্দিন আনন্দ-বেদনাকে নিজের মধ্যে অনুভব করে তিনি বিশ্ববাসীকে মানবধর্মের সর্বজনীন আদর্শে দীক্ষিত করেছিলেন। মানবসেবার ও ভালোবাসার এই বাণীকেই বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ পৃথিবীর নানা প্রান্তে পৌঁছে দিয়েছিলেন। ঈশ্বরকে এইভাবে জীবনের সমতলে নামিয়ে আনা এবং ব্যক্তিজীবনের সাধনা-কর্মপ্রচেষ্টায় মনুষ্যত্বের সর্বোত্তম প্রকাশই বাঙালির অধ্যাত্মসাধনার মর্মবাণী।


8. 'মুক্ত হইব দেব-ঋণে মোরা মুক্তবেণীর তীরে'-'আমরা' কবিতা অবলম্বনে উদ্ধৃতাংশটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো। ৫

উত্তরঃ স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি কবি সত্যেন্দ্রনাথের আত্যন্তিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ প্রকাশিত হয়েছে 'আমরা' কবিতায়। জন্মভূমির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে কবি মুগ্ধ হয়েছেন। তুষার-শুভ্র হিমালয়ের কাঞ্চনশৃঙ্গ, সাগরজলে স্নাত বঙ্গভূমির চরণপদ্ম এবং বিচিত্র রঙের পুষ্পবিন্যাস এদেশের সৌন্দর্যকে আরও মনোহর করে তুলেছে। এখানে বঙ্গমাতার খেতজোড়া সোনার ও ফসল, মায়ের বুকের স্নেহের মতোই কবিকে মায়ার বাঁধনে বেঁধেছে। তাই সুজলা-সুফলা-মুক্তিদায়িনী বঙ্গভূমি কবির কাছে চিরবাঞ্ছিত ভূমি। দেবতার অশেষ কৃপা ও আশীর্বাদে আমরা বাঙালি হিসেবে জন্মগ্রহণ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছি; এমনটাই কবি বিশ্বাস করেন।

বাঙালির শৌর্য ও সাহসিকতার একটি সুমহান অতীত আছে। বাঘ ও সাপের প্রতিকূলতাকে জয় করে সে যেমন তাঁর সভ্যতাকে গড়ে তুলেছে, তেমনই রামচন্দ্রের প্রপিতামহের সঙ্গে যুদ্ধ করে সে তাঁর অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছে। আবার দুঃসাহসী বিজয়সিংহ আমাদের বঙ্গভূমির বিজয়গাথাকেই সিংহল অবধি প্রসারিত করেছেন। আর এই শৌর্যের উত্তরাধিকার বলেই বাঙালি মগ ও মোগলের কাছে কখনোই প্রাণ থাকতে মাথানত করেনি। সাহিত্যে-দর্শনে-শিল্পকলায় এই বঙ্গমাতা রত্নগর্ভা। তাই - পালযুগের বিখ্যাত ভাস্কর বিপাল আর ধীমান, বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর, কান্ত-কবি জয়দেব, নব-ন্যায়ের তর্কচূড়ামণি রঘুনাথ বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে করেছেন প্রসারিত ও সমৃদ্ধ। আর বাঙালির হৃদয়-অমৃত মন্থন করে শ্রীচৈতন্য দেহরূপ ধারণ করেছেন এবং বিবেকানন্দ মানবসেবার সেই সাধনাকেই বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। আবার বিজ্ঞানসাধক জগদীশচন্দ্র বসু ও প্রফুল্লচন্দ্রের কাজ আদায় করে নিয়ে এসেছে জগৎজোড়া স্বীকৃতি। তাই কবি মনে করেন রবীন্দ্রনাথের মহামিলনের গান, কীর্তন-বাউলের মিলনকামী ঐতিহ্যকে বাঙালি ধারণ ও বহন করে নিয়ে চলেছে। তার এই বাঙলায় জন্ম বিফল নয়। পুণ্যতোয়া গঙ্গার তীরে জগৎবাসীকে মিলনের মহামন্ত্রে দীক্ষিত করেই সে দেবঋণ থেকে মুক্ত হবে।


No comments:

Post a Comment