জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়: বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে মানিক বন্দোপাধ্যায় এক উজ্জ্বল নাম। বাস্তব জীবনের রূপায়নে এবং স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি ছিলেন অনন্য। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মে ঝাড়খন্ড রাজ্যের (তৎকালীন বিহার) দুমকায় মানিক বন্দোপাধ্যায়ের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম হরিহর বন্দোপাধ্যায়, মায়ের নাম নীরদা দেবী। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পৈত্রিক নিবাস ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের কাছে মালবদিয়ায়। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের আসল নাম প্রবোধকুমার বন্দোপাধ্যায়। গায়ের রং কালো ছিল বলে তাঁর ডাকনাম হয়েছিল কালিমানিক তথা মানিক। এই মানিক নামেই তিনি পরবর্তীকালে পরিচিতি পান। তাঁর বাবার বদলির চাকরি থাকায় বাংলা ও বিহারের (অবিভক্ত) বিভিন্ন স্থানে লেখকের শৈশব কেটেছে।
(You can read in English also)
ছাত্র জীবন: মানিক বন্দোপাধ্যায়ের বাবা কলকাতা থেকে টাঙ্গাইলে বদলি হয়ে যাওয়ার পর মিত্র ইনস্টিটিউশনের ছাত্র শিশু মানিক টাঙ্গাইল জিলা স্কুলে ভর্তি হন। শৈশবে ছাত্রবাসস্থানে তিনি খুব দুরন্ত হয়ে ওঠেন এবং মাঝেমাঝেই বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যেতেন। প্রতিবারই তাঁকে খুঁজে পাওয়া যেত মাঝিদের নৌকায় বা গাড়োয়ানদের গাড়িতে কিংবা আস্তাবলে। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি মাতৃহারা হন। এরপর বাবার বদলি সূত্রে তাঁকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মহিষাদল, কাঁথী, মেদিনীপুর প্রভৃতি স্থানে থাকতে হয়। মেদিপুরে থাকাকালীন মানিক ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর জেলা স্কুলে থেকে প্রবেসিকা পরীক্ষা দেন এবং প্রথম বিভাগে পাস করেন। বাঁকুড়ার ওয়েসলিয়ন মিশন কলেজ থেকে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি আই. এস. সি পাশ করেন। এই বছরই তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিত সম্ননিক (অনার্স) নিয়ে বিএসসিতে ভর্তি হন। মানিক বন্দোপাধ্যায় কলেজজিবনে গান গাওয়া, কুস্তি লড়া, বাঁশি বাজানো এসবের প্রতি খুব অনুরক্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু স্নাতক স্তরের শিক্ষা তার আর শেষ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সাহিত্য সাধনার নেশা তাঁকে এমনভাবে পেয়ে বসে যে, প্রথাগত পড়াশোনায় তাঁকে দাড়ি টানতে হয়। (Read GK)
কর্ম জীবন: সাহিত্যের জগতে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের আবির্ভাব ঘটেছিল আংশিক ভাবে । প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময় কথাপ্রসঙ্গে এক বন্ধু তাঁকে বলেছিলেন যে, নামকরা লেখক না হলে বিখ্যাত পত্রিকাগুলি লেখা ছাপায় না। কিন্তু মানিক বন্দোপাধ্যায় দৃঢ়বিশ্বস ছিল যে, লেখা ভালো হলে অনামী লেখকের রচনাও নিশ্চয় ছাপা হবে। বন্ধুদের ভুলে প্রমাণ করতে মানিক ' অতসী মামী' নামন একটি গল্প লেখে তখনকার নামি পত্রিকা "বিচিত্রার" অফিসে জমা দিয়ে আসেন। লেখক হিসেবে তিনি প্রবোধকুমার নাম না দিয়ে মানিক বন্দোপাধ্যায় নামটিই সেখানে ব্যাবহার করেন। যথাসময় সেই গল্পটি মুদ্রিত হয় এবং লেখক ও পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে মানিকের কাছে লেখার জন্য অনুরোধ আসতে থাকে। তিনিও মনপ্রাণ দিয়ে লিখতে থাকেন। অবশেষে লেখাপড়ায় ইতি টেনে তিনি সাহিত্যকর্মকেয় পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে মানিক ' বঙ্গশ্রী পত্রিকার সহসম্পাদক নিযুক্ত হলেও পত্রিকার মালিকের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সেই চাকরিতে ইস্তফা দেন। এরপর তিনি তাঁর ছোটভাই সুবধকুমার বন্দোপাধ্যায এর সঙ্গে ' উদয়াচল প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিশিং হাউস ' নামক একটি প্রেস ও প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। সারাজীবন এই প্রতিভাবান সাহিত্যিককে দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়েছে।
সাহিত্য কর্ম: কলেজে পড়া কালীন আঙ্কসিকভাবে সাহিত্যজগতে মানিক বন্দোাপাধ্যায়ের প্রবেশ ঘটে। তাঁর রচনারিতি নিয়ে সাহিত্য সমালোচকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।(Read in English) কেউ কেউ তিনি প্রথম দিকে ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হলেও তাঁর শেষ ১২ বছরের লেখোকজীবনকে প্রভাবিত করেছিলেন প্রখ্যাত দার্শনিক কার্ল মার্সক।
মানিক বন্দোপাধ্যায় উপন্যাস এবং ছোট গল্প দুই রচনা করেছেন। এই কথাসাহিত্যিক ৫৭টি গগ্রন্থের রচয়িতা। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি হল, জননী (১৯৩৫), পুতুলনাচের ইতিকথা ( ১৯৩৬), পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬), দর্পণ (১৯৪৫), শহরবাসের ইতিকথা (১৯৪৬), চতুষ্কোণ (১৯৪৮), স্বাধিনতার স্বাদ(১৯৫১), সোনার চেয়ে দামী (১৯৫১), ইতিকথার পরের কথা (১৯৫২), হলুদ নদী সবুজ বন (১৯৫৬), ইত্যাদি।লেখকের জনপ্রিয় ছোট গল্পের মধ্যে প্রাগৈতিহাসিক (১৯৩৭), সরীসৃপ (১৯৩৯), বউ (১৯৪০), হলুদ পড়া (১৯৪৯), সর্পিল আত্মহত্যার অধিকার, নাকি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। অতসী মামী ও অন্যান্য গল্প (১৯৪৪), আজ কাল পরশুর গল্প (১৯৪৬), পরিস্তিতি (১৯৪৬), লাজুকলতা (১৯৫৩), প্রভৃতি লেখকের উল্লেখযোগ্য গল্প গ্রন্থ।
জীবনাবসান: মানিক বন্দোপাধ্যায় দীর্ঘ জীবনের অধিকারী হননি।তাঁর সাহিত্য জীবন কেটেছে চরম দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করে। নানাপ্রকার অসুখের আক্রান্ত হয়ে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে এই অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষটি জীবনাবসান ঘটে। (যেকোনো ধরনের GK পড়তে ক্লিক করুন)
বিখ্যাত লেখা
পুতুলনাচের ইতিকথা
এক খালের ধারে প্রকাণ্ড বটগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়া হারু ঘােষ দাঁড়াইয়া ছিল । আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন । হারুর মাথায় কাচা - পাকা চুল আর মুখে বসন্তের দাগভরা রুক্ষ চামড়া ঝলসিয়া পুড়িয়া গেল । সে কিন্তু কিছুই টের পাইল না । শতাব্দীর পুরাতন তরুটির মূক অবচেতনার সঙ্গে একান্ন বছরের আত্মমমতায় গড়িয়া তােলা চিন্ময় জগৎটি তাহার চোখের পলকে লুপ্ত হইয়া গিয়াছে । কটাক্ষ করিয়া আকাশের দেবতা দিগন্ত কাপাইয়া এক হুঙ্কার ছাড়িলেন । তারপর জোরে বৃষ্টি চাপিয়া আসিল । বটগাছের ঘন পাতাতেও বেশিক্ষণ বৃষ্টি আটকাইল না । হারু দেখিতে দেখিতে ভিজিয়া উঠিল । স্থানটিতে ওজনের কঁাজালাে সামুদ্রিক গন্ধ ক্রমে মিলাইয়া আসিল । অদূরের ঝােপটির ভিতর হইতে কেয়ার সুমিষ্ট গন্ধ ছড়াইয়া পড়িতে আরম্ভ করিল । সবুজ রঙের সরু লিকলিকে একটা সাপ একটি কেয়াকে পাকে পাকে জড়াইয়া ধরিয়া আচ্ছন্ন হইয়া ছিল । গায়ে বৃষ্টির জল লাগায় ধীরে ধীরে পাক খুলিয়া ঝােপের বাহিরে আসিল । ক্ষণকাল স্থিরভাবে কুটিল অপলক চোখে হারুর দিকে চাহিয়া থাকিয়া তাহার দুই পায়ের মধ্য দিয়াই বটগাছের কোটরে অদৃশ্য হইয়া গেল । হারুকে সহজে এখানে কেহ আবিষ্কার করিবে , এরূপ সম্ভাবনা কম । এদিকে মানুষের বসতি নাই । এদিকে আসিবার প্রয়ােজন কাহারাে বড় একটা হয় না , সহজে কেহ আসিতেও চায় না । গ্রামের লােক ভয় করিতে ভালবাসে । গ্রামের বাহিরে খালের এপারের ঘন জঙ্গল ও গভীর নির্জনতাকে তাহারা ওই কাজে লাগাইয়াছে । ভূত - প্রেতের অস্তিত্ব হয়তাে গ্রামবাসীরই ভীরু কল্পনায় , কিন্তু স্থানটি যে সাপের রাজা তাহাতে আর সন্দেহ নাই । দিনের আলাে বজায় থাকিতে থাকিতে বাজিতপুরের দু - একটি সাহসী পথিক মাঠ ভাঙিয়া আসিয়া ঘাসের নিচে অদৃশ্যপ্রায় পথ - রেখাটির সাহায্যে পথ সংক্ষেপ করে । বলিয়া - কহিয়া কারাে নৌকায় খাল পার হইলেই গাওদিয়ার সড়ক । গ্রামে পৌছিতে আর আধ মাইলও হাঁটিতে হয় না । চণ্ডীর মা মাঝে মাঝে দুপুরবেলা এদিকে কাঠ কুড়াইতে আসে । যামিনী কবিরাজের চেলা সপ্তাহে একটি গুল্মলতা কুড়াইয়া লইয়া যায় । কার্তিক - অগ্রহায়ণ মাসে ভিগায়ের সাপুড়ে
No comments:
Post a Comment