◼️কবি পরিচিতি;
১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় অম্বিকাপুর গ্রামে জসীমউদ্দিন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতার বইগুলি হল—নকশী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, বালুচর, ধানক্ষেত, রাখালী ইত্যাদি। বেদের মেয়ে গীতিনাট্য, চলে মুসাফির ভ্রমণকাহিনি, ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায় তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনা । তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক 'ডিলিট' উপাধিতে এবং বাংলাদেশে সরকার কর্তৃক ‘একুশে পদক' দ্বারা সম্মানিত হন। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মার্চ তাঁর মৃত্যু হয় ।
◼️নামকরণ;
চিঠি আসলে স্থানান্তরে থাকা মানুষকে লেখে আর-এক মানুষ। চিঠির অক্ষরে মনের কথা লিখে তারা একে অপরকে পাঠায়। যদিও এখানে যে চিঠির কথা বলা হয়েছে, তা আসলে পল্লিপ্রকৃতির চিঠি | প্রকৃতির ছোট্ট ছোট্ট রূপের প্রকাশ যেন চিঠির আকারে প্রকাশিত হয়েছে কবির কাছে। চিঠিতে যেমন ধরা পড়ে মানুষের সুখ, দুঃখ, আনন্দের ছবি, ঠিক তেমনই এখানে প্রকৃতি তার রূপ, রস ও গন্ধ নিয়ে সাড়া দিয়েছে কবির চোখে। সেই প্রকাশগুলি যেন কবির কাছে এক-একটি খোলা চিঠির মতো। তাই এই কবিতার নাম হিসেবে 'চিঠি' নামকরণটি সার্থক হয়েছে ।
◼️সারমর্ম;
আলোচ্য কবিতায় কবি লাল মোরগের ভোরবেলার ঘুমভাঙানো আওয়াজ ভরা এক চিঠি পাওয়ার কথা বলেছেন। তার গায়ে লেগে আছে শিশু ঊষার রঙিন হাসি। বালুচরের ঝিকিমিকি আলোয় ভরা চিঠি তিনি পেয়েছেন চখাচখির কাছ থেকে। সেখানে বর্ষার ঢেউয়ের দাগ যেন কত কিছু লিখে গেছে। গাঙশালিক লিখে গেছে কবি যেন গাঙপাড়ের মোড়ল হন, লিখে গেছে জোয়ারের স্রোতে ভরা নদীর কলতানের গল্প ।
বাবুই পাখির বাসা থেকে তিনি যেন ধানপাতা অথবা তালপাতায় বোনা নকশার চিঠি পেয়েছেন। কোড়াকুড়ী পাখির চিঠি থেকে তিনি বর্ষার জলধারায় নেচে ওঠা সবুজ ফসলখেতের কথা জেনেছেন। আকাশ জুড়ে মেঘের ঘনঘটায় বিদ্যুতের চমক অথবা ঝোড়ো হাওয়ার দাপটের খবরও তিনি এভাবেই জানতে পারেন।
সেই সঙ্গে তাঁর কাছে আসে তাঁর আদরের খোকাভাইয়ের একটি চিঠি। সেখানে শীতের সকালের রোদের মতো মিষ্টি কিছু কথা লেখা রয়েছে । উদার নীল আকাশে পাখিরা যে মিষ্টি সুরে মেঘেদের পাড়ায় ডেকে ফেরে, সেই সুন্দর সুরই যেন তাঁর আদরের খোকাভাইয়ের রঙিন হাতের আখরে চিঠিতে ফুটে উঠেছে। কবির কাছে সেই চিঠির কথাগুলি যেন খুশির নূপুরের মতো ঝমঝমিয়ে বেজে উঠেছে।
◼️নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর দাও।
১. কবি জসীমউদ্দিনকে বাংলা কাব্যজগতে কোন্ অভিধায় অভিহিত করা হয়েছে?
উত্তর: কবি জসীমউদ্দিনকে বাংলা কাব্যজগতে ‘পল্লিকবি' অভিধায় অভিহিত করা হয়েছে।
২. তাঁর লেখা দুটি কবিতার বইয়ের নাম লেখো ।
উত্তর: কবি জসীমউদ্দীনের লেখা দুটি কবিতার বইয়ের নাম রাখালী ও সোজন বাদিয়ার ঘাট।
৩. কবি কার কার থেকে চিঠি পেয়েছেন ?
উত্তর: কবি লাল মোরগ, চখাচখি, বাবুই পাখি, কোড়াকুড়ী এবং খোকাভাইয়ের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছেন।
৪.লাল মোরগের পাঠানো চিঠিটি কেমন ?
উত্তর: লাল মোরগের পাঠানো চিঠিটি ভোরজাগানো সুরে ভরা এবং শিশু উষার রঙিন হাসিতে রাঙানো।
৫. চখাচখি কেমন চিঠি পাঠিয়েছে?
উত্তর: চখাচখি বালুচরের খবর জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। সেখানে বর্ষা যেন তার ঢেউয়ের দোলায় প্রচুর কথা লিখেছে
৬. গাঙশালিক তার চিঠিতে কবিকে কি হতে বলেছেন?
উত্তর: গাঙশালিক তার চিঠিতে কবিকে গাঙের পাড়ের মোড়ল হতে বলেছে।
৭. বাবুই পাখির বাসার থেকে আসা চিঠিটি কেমন?
উত্তর: বাবুই পাখির বাসার থেকে আসা চিঠিটিতে ধানের পাতা আর তালের পাতায় বোনা নকশা আঁকা।
৮. কোড়াকুড়ীর পাঠানো চিঠিটির বর্ণনা দাও।
উত্তর; কোড়াকুড়ীর পাঠানো চিঠিটিতে বর্ষার ফসলের খেতের বর্ণনা রয়েছে। সেখানে নতুন জলের ধারার আনন্দে মেতে সবুজ পাতাগুলি যেন নাচের আসর বসিয়েছে। আকাশজুড়ে বর্ষার মেঘ ডাকছে। উদাস হাওয়া যেন ঘুরেফিরে কারোর জন্য আকুল হয়ে আছড়ে পড়ছে।
৯. কার চিঠি পাওয়ায় কবির মনে হয়েছে নিখিল বিশ্ব তাঁকে চিঠি পাঠিয়েছে?
উত্তর: খোকাভাইয়ের চিঠি পাওয়ায় কবির মনে হয়েছে যে নিখিল বিশ্ব তাঁকে চিঠি পাঠিয়েছে।
১০. এই কবিতায় কোন্ ঋতুর প্রসঙ্গ রয়েছে ?
উত্তর: ‘চিঠি' কবিতায় বর্ষা ঋতুর প্রসঙ্গ রয়েছে।
১১. কবিতায় অন্য ঋতুর পটভূমি সত্ত্বেও খোকাভাইয়ের চিঠির লেখনখানি ‘শীতের ভোরের রোদের মতো' মিঠে মনে হওয়ার তাৎপর্য বুঝিয়ে দাও।
উত্তর: শীতের সকালের একটুকরো রোদ জমাট ঠান্ডার মধ্যেও যে উন্নতার ছোঁয়া এনে দেয়, তা খুবই আরামের। এই রোদের উত্তাপ প্রবল শীতে প্রকৃতির অসমান্য আদরের মতোই দামি আবার কবির কাছে তাঁর খোকাভাইয়ের চিঠিটিও পরম।
আদরের, মূল্যবান। তাই তিনি চিঠির লেখনখানিকে শীতের ভোরের রোদের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
১২. “খুশির নূপুর ঝুমুর-ঝামুর বাজছে আমার নিরালাতে” —পঙ্ক্তিটির অর্থ বুঝিয়ে দাও।
উত্তর: ‘নিরালা' শব্দটির অর্থ নির্জন। কবির চারপাশে কেউ নেই । তিনি একাকী নির্জনে বসে আছেন। কিন্তু তাঁর প্রিয় খোকাভাইয়ের চিঠি তাঁর কাছে প্রকৃতির রঙিন স্পর্শ নিয়ে যেভাবে ধরা দিয়েছে, তাতে তিনি আর একা নেই। সকলের আনন্দ যেন খুশির নূপুরের মতো ঝমঝমিয়ে বেজে উঠে নীরবতাকে ভেঙে দিচ্ছে।
◼️নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর নিজের ভাষায় লেখো।
১. কবি প্রকৃতির কোন্ কোন্ প্রতিনিধির কাছ থেকে কেমন সমস্ত চিঠি পেয়েছিলেন, বিশদে লেখো ।
উত্তর: কবি লাল মোরগ, চখাচখি, বাবুই পাখি ও কোড়াকুড়ীর কাছ থেকে চিঠি পেয়েছিলেন। লাল মোরগের চিঠিতে ভরা ছিল ভোরবেলার ঘুমভাঙানোর সুর। চিঠিখানি শিশু ঊষার রঙিন হাসিতে রঙিন হয়ে আছে। চখাচখির চিঠিতে রয়েছে বর্ষার ঢেউয়ের ছাপ লেগে থাকা ঝকঝকে বালুচরের খবর। সেখানে গাঙশালিক আবার কবিকে গাঙের পাড়ের মোড়ল হতে লিখে গেছে, জলের স্রোতে ঢেউয়ের কলকলানির শব্দ তাতে মিশে রয়েছে ।
বাবুই পাখি তার বাসা থেকে ধান আর তালের পাতার বুনুনিতে নকশা করা চিঠি পাঠিয়েছে কবিকে। কোড়াকুড়ী কবিকে যে চিঠি পাঠিয়েছে, তাতে রয়েছে বর্ষাকালের জলে-ডোবা ফসলের খেতে সবুজ পাতাগুলির নাচানাচি করার খবর | আকাশজুড়ে বাদল দিনের মেঘের গুরুগুরু গর্জন আর পাগলা বাতাসের আছড়ে পড়ার শব্দও মিশে থাকে সেই চিঠিতে।
২. খোকাভাইয়ের চিঠিটির প্রসঙ্গে কবি যে সমস্ত উপমা ও তুলনাবাচক শব্দ ব্যবহার করেছেন তাদের ব্যবহারের সার্থকতা বুঝিয়ে দাও ।
উত্তর: খোকাভাইয়ের চিঠিটিকে কবি শীতের ভোরের রোদ, দূর আকাশের সুনীল পাতা এবং খুশির নূপুরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। শীতের সকালের জমাট ঠান্ডার মধ্যে সদ্য ওঠা নরম রোদের উত্তাপের স্পর্শ যেমন মিষ্টি, তেমনই আরামদায়ক। কবির কাছেও তাঁর প্রিয় খোকাভাইয়ের চিঠিটি একইরকম মিষ্টি আমেজ বয়ে নিয়ে এসেছে। তিনি বলেছেন দূর আকাশের গাঢ় নীল রঙের পাতা থেকে ঝাঁক ঝাঁক পাখি যেন ছড়া মুখস্থ করে মেঘেদের পাড়ায় মেঘেদের পড়ায়। ঠিক সেই পড়ার হরফগুলিই যেন তাঁর খোকাভাইয়ের হাতের অক্ষরে ফুটে উঠেছে। তাঁর একাকীত্ব, নির্জনতা সব কেটে গিয়ে যেন খুশির নূপুর রুমঝুমিয়ে বাজতে থাকে ।
No comments:
Post a Comment